News ROOM




ইসরাইল বিশ্বের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি রাষ্ট্র। ইসরাইল ঠিক যে পন্থায় বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছে মনে হয় আর কোনও রাষ্ট্র এমন পন্থায় পরিচিতি লাভ করেনি। বিশ্বের অনেক দেশ তাদের উন্নয়ন ও আধুনিকতার কারণে সারা পৃথিবীতে পরিচিত তবে ইসরাইল এমন একটি দেশ যে দেশটি বিশ্বে হত্যাযজ্ঞের কারণে পরিচিত। খবরের পাতা উল্টালেই বা টিভি অন করলেই ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের খবর ও ইসরাইলের নির্মমতার খবর অহরহ শোনা যায়।
মুসলমানরা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরাইল রাষ্ট্রকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে থাকে। এই ঘৃণার পিছনের কারণও অযথা নয়, কারণ এই ইসরাইলের হামলায় গত ৪০ বছরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনের রক্ত ধারা প্রবাহিত হয়েছে। বিনা দোষে কোনও প্রকার কারণ ছাড়াই ইসরাইল ফিলিস্তিনি মুসলমানদের হত্যা করে এবং রক্তে রঞ্জিত করে মুসলিম এলাকা। মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মোকাদ্দাস দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে ইসরাইল বাহিনী। ফলে ইসরাইল সকল মুসলিমদের চোখে প্রধান শত্রু। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পুষ্ট ইসরাইল বিশ্বের কোনও দেশকেই তোয়াক্কা করে না। তারা নির্বিচারে প্রতিনিয়ত হত্যা করে চলেছে মুসলমানদের। কিন্তু তাদের দমন করার যেন কেউ নেই।
মধ্যপ্রাচ্যের সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ইসরাইল ভূমধ্য সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত। ইসরাইলের রাজধানীর নাম জেরুজালেম। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রই ইসরাইলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিব্রু ও আরবি। ২০ বর্গ কিলোমিটারের এই রাষ্ট্রটির অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই ইহুদী ধর্মাবলম্বী। ইসরাইল রাষ্ট্রটির জন্ম ইতিহাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারণ, বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কৌশলে ইসরাইল রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মাঝখানে ইসরাইল একটি জ্বলন্ত সমস্যার নাম। আসুন এখন জানা যাক কিভাবে বহুল আলোচিত এই ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল।

১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে মুসলমান শাসকদের অদূরদর্শিতা এবং ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের কারণে তুরস্কে মুসলিম খিলাফত ভেঙ্গে যায়। ব্রিটিশ বাহিনী ১৯১৭ সালে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও পবিত্র জেরুজালেম দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা প্রথম ফিলিস্তিনে পদার্পণ করে ফিলিস্তিন জয়কারী মুসলিম বীর সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মাযার শরীফ এ গিয়ে তার মাযারে পদাঘাত করে উচ্চস্বরে বলতে থাকে হে সালাহ উদ্দিন উঠে দেখ আমরা তোর সিরিয়া জয় করে এসেছিপ্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন সহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বালফোর ইহুদীবাদীদেরকে লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। কিন্তু ব্রিটিশরা চাইনি ইহুদীদের ইউরোপে জায়গা দিয়ে জঞ্জাল সৃষ্টি করতে। কারণ তারা জানতো ইহুদীরা ঐতিহ্যগতভাবেই শয়তান। ইহুদীদের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্রের চিন্তা শুরু হলে পৃথিবীর কোন দেশ তাদের ভূখণ্ডে ইহুদীদের বসাতে রাজী হয়নি। তাই শেষ পর্যন্ত বেলফোর ঘোষণা অনুযায়ী ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রে গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ইহুদীদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ার পর বিপুল সংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। দুর্বল শক্তির কারণে প্রথম পর্যায় থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান রাষ্ট্র সমূহ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের আগমনকে বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়।
 
ইহুদীরা ফিলিস্তিন আসা শুরু করলে ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। কিন্তু ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। এরপর শুরু হয় বিশ্ব ইহুদীদের একত্রিত করার কাজ। মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণ, তাদের শক্তি খর্ব, তাদের মাঝে অনৈক্য স্থাপন ও মুসলমানদের দমনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে ইহুদী অভিবাসীদের ধরে এনে ফিলিস্তিনে জড়ো করার কাজ শুরু করা হয়। ফলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ সাল নাগাদ ফিলিস্তিনে ইহুদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৫ হাজারে পৌঁছে যায়। ধীরে ধীরে ইসরাইল ইহুদীদের জন্য নিরপরাধ ও স্বাধীন এলাকা হিসেবে গড়ে উঠার ফলে সেখানে ইহুদীর সংখ্যা দ্রুতই বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৩১ সালে ইহুদীদের সংখ্যা প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৮০ হাজারে পৌঁছায় এবং ১৯৪৮ সালে সেখানে ইহুদীদের সংখ্যা ৬ লাখে উন্নীত হয়।
১৯১৮ সালে ব্রিটেনের সহযোগিতায় ইসরাইলের গুপ্ত ইহুদী বাহিনী হাগানাহগঠিত হয়। এ বাহিনী ইহুদীবাদীদের অবৈধ রাষ্ট্র তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে ফিলিস্তিনী জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদীবাদীদের সহায়তা করা হাগানাহ বাহিনীর দায়িত্ব হলেও পরবর্তীকালে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনী জনগণের বাড়িঘর ও ক্ষেতখামার দখল করে তাদেরকে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর প্রধান কাজ। মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডটি একটি স্বাধীন ও একচ্ছত্র মুসলমানদের এলাকা হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করা সংক্রান্ত ১৮১ নম্বর প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ইহুদীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়ে মার্কিন ও ব্রিটেনের চক্রান্তকে সফল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র মুসলিম বিশ্বের বিরোধিতাকে তোয়াক্কা না করে ফিলিস্তিনকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রস্তাব পাশ করে।
এই প্রস্তাব অনুসারে জাতিসংঘ মুসলমানদের প্রাণের মাতৃভূমির মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনীদের প্রদান করে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি জোর করে ইহুদীবাদীদের হাতে ছেড়ে দেয়। এভাবে ফিলিস্তিনের ভূমিকে জোর পূর্বক দখল করে গঠন করা হয় নতুন ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৪৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল ছোট রাষ্ট্রগুলোকে চাপ দিতে থাকে জাতিসংঘে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলের পক্ষে ভোট দেয়ার জন্য। মার্কিনদের প্রবল চাপ ও মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েলকে জাতিসংঘ ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা প্রদান করে।
স্বাধীনতা লাভ করার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের সাহায্যে ইসরাইল অস্ত্র-শস্ত্র ও শক্তিতে পরাক্রমশালী হয়ে উঠে। যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভূমি দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সেই ফিলিস্তিনকে পরাধীন করে ফিলিস্তিনের বাকি ভূমিগুলোকেও দখলের পায়তারা করতে থাকে ইসরাইল। বিনা অপরাধে, বিনা উস্কানিতে ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো মার্কিনীদের সেবা দাসে পরিণত হওয়ায় তারা ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে খুব বেশী আন্দোলন মুখর হতে ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ মুসলিম দেশ ইসরাইলকে ঘৃণা করলেও অনেক মুসলিম রাষ্ট্র ইসরাইলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিও দেয়। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী প্রথম মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রটি ছিল মিশর।
ফিলিস্তিনি ভূমি জোর করে দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করার পর থেকে ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার আদায়ের চেষ্টা করে চলেছে। ১৯৬৪ সালে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠন PLO প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে দীর্ঘদিন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে ফিলিস্তিনিরা। ইয়াসির আরাফাতের ইন্তেকালের পরও এখনো স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়ে চলেছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনীরা।
ইসরাইলের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৪ লক্ষ ৬৫ হাজার। আমেরিকার মদদে ইসরাইল এখন এতটাই শক্তিশালী যে, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের রয়েছে একচ্ছত্র আধিপত্য। মুসলমানদের শক্তি হিসেবে বর্তমানে ইসরাইলকে চোখ রাঙ্গিয়ে আসছে ইরান। আর তাই ইরান-ইসরাইল এখন এক রণাঙ্গনের নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যেদিন বিশ্ব মানচিত্র থেকে ইসরাইলের নাম আবার মুছে যাবে। তবে সেটির জন্য দরকার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও মুসলিম রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে একতা। সত্যিই কি মানচিত্র থেকে মুছে যাবে ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল? এখন শুধু অপেক্ষার পালা!



সাঈদী কাঠগড়ায়, বিচারকরাও এজলাসে


বাংলানিউজ টিম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি: শোয়েব মিথুন / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর কাঠগড়ায় নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ১০ মিনিটে তাকে কাঠগড়ায় তোলা হয়।

ইতিমধ্যেই ট্রাইব্যুনালের এজলাসে বসেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর এবং বিচারক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও আনোয়ারুল হক।

এর আগে ৯টা ৩৫ মিনিটে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে পুলিশি পাহাড়ায় সাঈদীকে ট্রাইব্যুনালে নেওয়া হয়। তাকে রাখা হয়েছে ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়।

আর বিচারকরা আসেন ৯টা ৩৬ মিনিটে। তারা একে একে ট্রাইব্যুনালে প্রবেশ করেন। সকাল পৌনে ১১টায় তারা এজলাসে বসেন।  কিছুক্ষণ পরই শুরু হবে রায় ঘোষণা।

সাঈদীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এটি তৃতীয় রায়। এর আগে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসি ও আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

গত ২৯ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্যায়ে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। ওই দিন যে কোনো দিন সাঈদীর মামলার রায় দেওয়ার তারিখের আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) বলে রেখে দেন ট্রাইব্যুনাল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গঠনের পর প্রায় পৌনে তিন বছরের কাছাকাছি সময়ে এসে তৃতীয় কোনো অভিযুক্তের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হচ্ছে।

তবে সাঈদীর মামলার মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনাল-১-এ প্রথম কোনো মামলার রায় ঘোষিত হচ্ছে।

বাকি দুই মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে গত বছরের ২২ মার্চ গঠিত ট্রাইব্যুনাল-২-এ। এর মধ্যে ২১ জানুয়ারি ফাঁসির আদেশ দিয়ে জামায়াতের সাবেক রোকন (সদস্য) আবুল কালাম আজাদ বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন ওই ট্রাইব্যুনাল। একই ট্রাইব্যুনাল গত ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন।

পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ
গত ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে সাঈদীর মামলা পুনর্বিচারে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে ইতিপূর্বে শেষ হওয়া রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক ফের শুনবেন বলে আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ১৩ জানুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরুর মধ্য দিয়ে সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া দ্বিতীয়বারের মতো শেষ পর্যায়ে পৌঁছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৬ ডিসেম্বর মামলার সমস্ত বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর ২৩ ডিসেম্বর মামলাটির পুনর্বিচারের আবেদন জানান সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। ২৪ ডিসেম্বর থেকে ১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ কার্যদিবসে আবেদনগুলোর ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আসামিপক্ষে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এমপি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সিনিয়র আইনজীবী বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, আসামিপক্ষের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।

অপরদিকে আবেদনের বিরোধিতা করে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ বেলজিয়ামের ব্রাসেলস প্রবাসী বাংলাদেশি আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল-১-এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে এ আবেদন করেন আসামিপক্ষ।

ওই স্কাইপি কথোপকথনের সূত্র ধরে বিচারাধীন জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং ট্রাইব্যুনাল-২ এ জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলা ৪টিরও পুনরায় শুরু করার আবেদন গত ৩ ও ৭ জানুয়ারি খারিজ করে দেন দু’টি ট্রাইব্যুনাল।

১০ জানুয়ারি এসব খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) আবেদন করেন। ১৫-১৬ জানুয়ারি শুনানি শেষে ২১ জানুয়ারি সেসব আবেদনও ট্রাইব্যুনাল খারিজ করে দেওয়ায় মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রমের সকল প্রতিবন্ধকতা দূর হয়।

অন্যদিকে একই ঘটনার সূত্র ধরে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক পদত্যাগ করায় ট্রাইব্যুনাল-১ এর পাশাপাশি পুনর্গঠিত হয় দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালও। ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর প্রথম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন আর তার স্থলাভিষিক্ত হন এ ট্রাইব্যুনালেরই বিচারক প্যানেলের সদস্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।

মামলার ধারাবাহিক কার্যক্রম
বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর দায়ের করা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলায় সাঈদীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

২০১০ সালের ২১ জুলাই থেকে ২০১১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত মোট ৩১৩ দিন তদন্ত করে ১১ জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। ১৪ জুলাই তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শেষে ৩ অক্টোবর সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনকালে মুক্তিযুদ্ধকালে সময়ে পিরোজপুর জেলায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অপরাধে সাহায্য করা ও জড়িত থাকার ঘটনায় ২০টি অভিযোগ আনা হয়।

একই বছরের ২০ ও ২১ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সূচনা বক্তব্য (ওপেনিং স্টেটমেন্ট) উত্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু ও প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান।

এ মামলায় সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর। প্রায় সাড়ে চার মাসে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তাদের মধ্যে ২০ জন ঘটনার বিষয়ে এবং সাতজন জব্দ তালিকার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন।

ঘটনার সাক্ষীরা হলেন, মাহাবুব উদ্দিন হাওলাদার, রুহুল আমীন নবীন, মিজানুর রহমান তালুকদার, সুলতান আহমেদ হাওলাদার, মাহতাব উদ্দিন হাওলাদার, মানিক পসারি, মফিজ উদ্দিন পসারি, মোঃ মোস্তফা হাওলাদার, মোঃ আলতাফ হোসেন হাওলাদার, বাসুদেব মিস্ত্রি, আব্দুল জলিল শেখ, আব্দুল আওয়াল এমপি (বর্তমান), গৌরাঙ্গ চন্দ্র সাহা, আব্দুল হালিম বাবুল, মোঃ সেলিম খান, জুলফিকার আলী, মধুসূদন ঘরামী, মোঃ হোসেন আলী, মোঃ মোবারক হোসেন ও সাইফ হাফিজুর রহমান।

আর জব্দ তালিকার সাক্ষীরা হলেন, পিআইবির ক্যাটালগার মোঃ রবিউল আলম খান, পিআইবির চতুর্থ শ্রেণীর বুক সার্টার এসএম আমিরুল ইসলাম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড কাম কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা বেগম, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গাইড মোঃ নেছার, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারিক ইজাব উদ্দিন মিয়া, বাংলা একাডেমির গ্রন্থাগারিক ডিস্ট্রিবিউটর মাসুম উল কবির এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান।

রাষ্ট্রপক্ষের ২৮তম ও শেষ সাক্ষী হিসেবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন সাক্ষ্য দেওয়া শুরু করেন গত বছরের ৮ এপ্রিল। নয় কার্যদিবসে ২৪ এপ্রিল তার সাক্ষ্য শেষ হয়। আসামিপক্ষ ২৫ এপ্রিল তাকে জেরা শুরু করেন। ৪৮ কার্যদিবসে ১৩ আগস্ট তার জেরা শেষ হয়। এর মাধ্যমে শেষ হয় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা।

এছাড়াও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া ১৫ সাক্ষীর জবানবন্দি ট্রাইব্যুনালের আদেশে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তারা হচ্ছেন উষা রানী মালাকার, সুখরঞ্জন বালি, আশীস কুমার মণ্ডল, সুমতি রানী মণ্ডল, সমর মিস্ত্রি, সুরেশ চন্দ্র মণ্ডল, গণেশ চন্দ্র সাহা, শহিদুল ইসলাম খান সেলিম, মোঃ মোস্তফা, আব্দুল লতিফ হাওলাদার, আইয়ুব আলী হাওলাদার, সেতারা বেগম, অনিল চন্দ্র মণ্ডল, রানী বেগম ও অজিত কুমার শীল।

গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর থেকে সাঈদীর পক্ষের সাক্ষীদের সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে সাঈদীর পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দিতে আসামিপক্ষ ৪৮ জনের নামের তালিকা দিলেও ২০ জন সাক্ষীকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য অনুমোদন দেন ট্রাইব্যুনাল। ২০ জনের মধ্যে আসামিপক্ষ ১৭ জন হাজির করে সাফাই সাক্ষ্য দেওয়ান। গত ২৩ অক্টোবর তারা আর কোনো সাফাই সাক্ষী আনতে না পারায় সেদিনই সাফাই সাক্ষ্যগ্রহণ বন্ধ করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।

সাঈদীর পক্ষে যে ১৭ জন সাক্ষ্য দেন তারা হলেন শামসুল আলম তালুকদার, আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ, নুরুল হক হাওলাদার, আবুল হোসেন, খসরুল  আলম, রওশন আলী, জামাল উদ্দিন ফকির, কুবাত আলী, হেমায়েত উদ্দিন, গোলাম  মোস্তফা, আনোয়ার হোসেন, হাফিজুল হক, সাঈদীর ছেলে মাসুদ বিন সাঈদী, এমরান হোসাইন, আব্দুস সালাম হাওলাদার, আব্দুল হালিম ফকির ও গণেশ চন্দ্র সাহা।

উভয়পক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে গত বছরের ৫ নভেম্বর শুরু হয় প্রথম দফার যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন। রাষ্ট্রপক্ষে ৫ থেকে ১৫ নভেম্বর ও ৪ থেকে ৬ ডিসেম্বর মোট ১২ কার্যদিবসে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। অন্যদিকে ১৮ নভেম্বর শুরু করে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৩ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও অপর আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।

এরপরই স্কাইপি কথোকপথনের জের ধরে মামলার কার্যক্রম মুলতবি হয়ে যায়। ফলে ১ মাস ১৭ দিন বিলম্বিত হয় এ বিচারিক প্রক্রিয়া।

ট্রাইব্যুনাল ফের উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনার সিদ্ধান্ত নিলে গত ১৩ থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত এবং ২৮ ও ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী। অন্যদিকে ২০ থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ কার্যদিবসে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম।

সাঈদীর বিরুদ্ধে যতো অভিযোগ
সাঈদীর বিরুদ্ধে গঠন করা অভিযোগ, ৮৮ পৃষ্ঠার সূচনা বক্তব্য এবং ৭৭ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন হাজারেরও বেশি নিরস্ত্র ব্যক্তিকে হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা, নয়জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ, বিভিন্ন বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লুটপাট, ভাঙচুর এবং ১০০ থেকে ১৫০ হিন্দুকে ধর্মান্তরে বাধ্য করার ২০টি ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২) ধারা অনুসারে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ৪ মে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর নেতৃত্বাধীন দলের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের খবর দিয়ে পিরোজপুর সদর এলাকার মধ্য মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে নিয়ে যান। সেখানে পরিকল্পিতভাবে আগে থেকে জড়ো করা ২০ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়, ৪ মে সাঈদী ও তার দল পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় যান। সেখানে হিন্দু বাড়িগুলোতে লুট করেন এবং আগুন ধরিয়ে দেন। মানুষ পালাতে শুরু করলে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ করলে ১৩ জন শহীদ হন।

অভিযোগ-৩: ৪ মে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে মাসিমপুর হিন্দুপাড়ায় মনীন্দ্রনাথ মিস্ত্রী ও সুরেশ চন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন। সাঈদী নিজে বিভিন্ন গ্রামের রাস্তার পাশের অসংখ্য বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন।

অভিযোগ-৪: ৪ মে সাঈদী তার রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে ধোপাবাড়ির সামনে এবং পিরোজপুর সদর পুলিশ স্টেশনের এলজিইডি ভবনের পেছনের হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলেন। এ সময় গুলি চালানো হলে দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, জগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালা মারা যান।

অভিযোগ-৫: তৎকালীন পিরোজপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। সাঈদী ও তার সহযোগী শান্তি কমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে নিয়ে ৫ মে পিরোজপুর হাসপাতাল থেকে তাকে ধরে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান। একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরা হয়। সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির একটি দল পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পারেরহাট বাজারের আওয়ামী লীগ, হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের বাড়িঘর ও দোকান চিনিয়ে দেয়। এসব দোকান ও বাড়িতে লুটপাট করা হয়। এ সময় তারা মাখন লাল সাহার দোকান থেকে ২২ সের স্বর্ণ ও রুপা লুট করে।

অভিযোগ-৭: ৮ মে বেলা দেড়টার দিকে সাঈদী পাকিস্তানি সেনাদের নেতৃত্ব দিয়ে বাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগার ও শহীদুল ইসলামকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের হাতে সোপর্দ করেন। পরে তাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-৮: ৮ মে বেলা তিনটার দিকে সাঈদী ও তার দলের সদস্যরা চিথোলিয়া গ্রামের মানিক পসারির গ্রাম লুট করেন। এখানে পাঁচটি ঘরে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। মানিক পসারির ভাই মফিজুদ্দিন ও ইব্রাহিম কুট্টিকে ধরে সেনা ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার সময় সাঈদীর প্ররোচনায় পাকিস্তানি সেনারা ইব্রাহিম কুট্টিকে হত্যা করে। মফিজকে সেনাক্যাম্পে নির্যাতন করা হয়।

অভিযোগ-৯: ২ জুন সকাল নয়টার দিকে সাঈদী ও তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি পুলিশ স্টেশনের নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে লুটপাট করে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট এবং আগুন ধরিয়ে দেন।

অভিযোগ-১০: ২ জুন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে সশস্ত্র দল উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। সাঈদীর ইন্ধনে বিসা বালী নামের একজনকে নারকেল গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়।

অভিযোগ-১১: ২ জুন সাঈদী টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে তার বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করা হয়। এরপর সাঈদী নগদ টাকা লুট ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান। পরে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১২: সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের ১৪ জন হিন্দুকে ধরে দড়ি দিয়ে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে নিয়ে যায়। পরে তাদের গুলি করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৩: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে যায়। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয়। সাহেব আলীকে পিরোজপুরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়ায় যায়। রাজাকারদের আগমন দেখে গ্রামের অধিকাংশ হিন্দু নারী পালিয়ে যান। কিন্তু মধুসূদন ঘরামীর স্ত্রী শেফালী ঘরামী ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তখন সাঈদীর নেতৃত্বে রাজাকাররা তাকে ধর্ষণ করেন। এর ফলে স্বাধীনতার পর তিনি একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। এ নিয়ে গ্রামে বিভিন্ন কথা ওঠায় শেফালী ঘরামী দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন।  পরে এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৫: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে। পাকিস্তানি সেনারা তাদের সবাইকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

অভিযোগ-১৬: সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তার তিন বোন মহামায়া, অন্ন রানী ও কমলা রানীকে ধরে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৭: সাঈদী ও তার নেতৃত্বের রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপদ সাহার সাহার মেয়ে ভানু সাহাকে তার বাড়িতে আটকে নিয়মিত ধর্ষণ করেন। এক সময় ভানু সাহা দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।

অভিযোগ-১৮: ভাগীরথী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে কাজ করতেন। সাঈদী এক দিন খবর দেন, ভাগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত নানা খবরা-খবর দেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যা করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেয়।

অভিযোগ-১৯: সাঈদী প্রভাব খাটিয়ে পারেরহাটসহ অন্য গ্রামের ১০০-১৫০ জন হিন্দুকে ইসলাম ধর্মে রূপান্তর করে। তাদের মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে বাধ্য করা হতো।

অভিযোগ-২০: নভেম্বরের শেষ দিকে সাঈদী খবর পান, সাধারণ মানুষ ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। তার নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি সশস্ত্র দল পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ৮৫ জন ব্যক্তিকে আটক করে তাদের কাছ থেকে মালামাল কেড়ে নেওয়া হয়। ১০-১২ জন বাদ দিয়ে বাকিদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৩


 হাসিনার ডিজিটাল রত্নের এবারের কেলেঙ্কারী, একসাথে~~রাজকন্যা ও রাজত্ব~~

সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানের কন্যা আয়েশাকে চুপে চাপে বিয়ে করলেন জয়। গুলশানের এক বাড়িতে জানুয়ারীর ৪ তারিখে এ কীর্তি হয়। আয়েশা আজিজ খান সামিট পাওয়ার লিমিটেডের ফিন্যান্স ডিরেক্টর হিসাবে বাবার সাথে ব্যবসায় আছেন।

অনেকে মাইন্ড করতে পারেন, জয় বিয়ে করেছে, কিন্তু ছবির লেখা এরকম কেনো? ফরমাল বিয়ে হলে এটা দেয়া হতো না। যে বন্ধু খবরটি দিয়েছেন, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় বিয়ে হয়েছে? তার জবাব...বোঝেন না....৩/৪ নম্বর বিয়া কোথায় হয়। Just বিছানায়। তাই, আমিও এর বাইরে কিচ্ছু দিতে পারলাম না...স্যরি।

১৯৮১ সালে জন্ম হওয়া আয়েশা লন্ডন থেকে বিবিএ এবং নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাশ করে বাবার ব্যবসায় (সামিট পাওয়ারে) যোগ দেন। জয়ের সাথে তার বয়সের ব্যবধান ১০ বছর। এটা জয়ের তৃতীয় বিয়ে হলেও আয়েশার কয় নম্বর তা জানা যায় নি। জয় ভারতের নৈনিতালে থাকতেই ভারতীয় এক শিখ মেয়েকে বিয়ে করে। হাসিনা যায় বৌ আনতে, কিন্তু সে মুসলমান হবে না বিধায় নিজের রাজনীতি রক্ষার্থে সে বিয়ে ভাঙ্গতে হুকুম দেয় ছেলেকে। সংসার ভাঙ্গা জয় চলে যায় আমেরিকায়। সেখানে ঘুরাঘুরি পরে জুটে যায় রিচার্ড ডি লুমির পরিত্যাক্ত স্ত্রী ক্রিস্টিনা ওভামায়ারকে। আমেরিকায় নাকি ঐটা কোনো ব্যাপার না। যখন তখন ধরে... আর ছাড়ে। ২৬ অক্টোবর ২০০২ থেকে বারো বছর চললো টালমাটালের সংসার। এর মধ্যে অনেক মারামারি, মদামদি, অবৈধ অস্ত্র নিয়ে ধরা 
খাওয়া, র‌্যাকলেস ড্রাইভিং, ফ্যামিলি ভায়োলেন্সসহ ৮/১০টা মামলায় কয়েক মাস জেলে থাকলো জাতীয় নাতি।

হালে আশেয়ার সাথে জয়ের মেলামেশা শুরু হওয়ার পরেই মায়ের উস্কানিতে জয় তার মার্কিনী স্ত্রী ক্রিস্টিনার সাথে গন্ডগোল শুরু করে। ক্রিস্টিনা জয়ের পরকীয়ার খবর পায়, তার সাথে যোগ হয় বাংলাদেশ থেকে লুটে আনা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ঝামেলা, পদ্মাসেতুর কয়েক মিলিয়ন ডলার কানাডা থেকে আনার পরে আমেরিকার এন্টি-মানিলন্ডারিং এজেন্সি এবং এফবিআই ইনভেস্টিগেশন শুরু করলে ক্রিস্টিনা মারাত্মকভাবে ক্ষেপে যায় এবং ডিভোর্স ফাইল করে। জয়ের মা উস্কানি দিয়ে জয়কে দেশে নিয়ে আসে। ভার্জিনিয়া ফ্যামিলি কোর্টে স্যাটাস্যাট হয়ে যায় সেদিন। ২ মিলিয়ন ডলার ড্যামারেজ এবং আর্লিংটনের ২টা বাড়ি ক্রিস্টিনা ও মেয়ে সোফিয়াকে লিখে দিয়ে আসে জয়। ব্যস, কম্ম কাবাড়! ইহুদি স্ত্রীর দুর্নাম তো ঘুচানো গেলো। এবার আর বাংলাদেশে রাজনীতি করতে ও ক্ষমতায় বসতে কোনো অসুবিধা হবে না ডিজিটাল নাতির। আয়েশাকে ঘরে তোলার সাথে এবারে বাড়তি হিসাবে চলে আসে সামিট গ্রুপের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।

মূলতঃ অনেক দিন থেকেই জয় সামিট গ্রুপের দায়িত্বে বসে গেছে। হবু শ্বশুর আজিজ খান তার ব্যবসার উন্নতি, ২২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্লান্ট নির্মানের কাজ পাওয়া, কৃত্রিম উপগ্রহ প্রজেক্ট ইত্যাদির জন্য হাইভোল্টেজ জয়ের স্মরণাপন্ন হয়। আর ঘুসঘাস ঠিক করার জন্য আজিজ খান এগিয়ে দেয় মেয়ে আয়েশাকে। কচি মাংশের স্বাদ যেমন বাঘের, এরপরে তেমন ঘটনাই ঘটলো।
 
Photo: ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদকে। নৃশংস কায়দায় তাকে হত্যা করার পর চোখ উপড়ে লাশ ফেলে রাখা হয়। যা দেখে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অাঁতকে উঠেছে। রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি আবিদ শান্তশিষ্ট স্বভাবের ধার্মিক এক তরুণ। যার মৃত্যুতে তার পরিবার পরিজন, এলাকাবাসী সহ সবাই শোকে বিহবল হয়ে পড়ে। সবার জিজ্ঞাসা কেন এই ছেলেকে রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি হয়ে নিমর্মভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।

শহীদ ভাইয়ের রক্তের সাথে বেঈমানী করতে পারবে না বলে জননীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল মঙ্গলবার ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদ বিন ইসলাম। ওইদিন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মাকে আবিদ বলেন, তার ছেলে যদি কখনো শহীদ হয়ে যায়, শহীদের মা হিসেবে যেন তিনি চলেন। গত মঙ্গলবার হরতালের প্রথমদিনে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাট এলাকায় সন্ধ্যায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হামলায় নিমর্মভাবে মারা যায় ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদ বিন ইসলাম।

আবিদের পিতা এডভোকেট মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তার ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আবিদের শরীরে দুইটি গুলীর দাগ দেখা যায় আর চোখ দুইটি উপড়িয়ে ফেলা হয়। তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধারের নামে নাটক সাজায় বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আবিদের শরীরের বিভিন্নস্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতও দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর নতুন এ ব্লক এলাকায় ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। আবিদ ফেইসবুকে নিজেকে ইসলামের জন্য কবুল করার আবেদন করেন পরম করুণাময়ের কাছে। তার ইচ্ছা আল্লাহ তায়ালা পূরণ করেছেন বলে জানান আবিদের গর্বিত পিতা এডভোকেট মোঃ মনিরুল ইসলাম।

আবিদের পিতা এডভোকেট মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, আবিদের চোখে ছিল মায়াবী আকর্ষণ। দশম শ্রেণীতে তিনি ছাত্রশিবিরের সাথী হয়। তিনি ছাত্রশিবিরের সর্ব কনিষ্ট সাথী বলে পিতা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান। তার দুই ছেলের মধ্যে আবিদ ছোট। আবিদ নামাযের ইমামতি করতেন আর পিতা ও বড় ভাই তার পিছনে নামায আদায় করতেন। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। আবিদ বিন ইসলামের গ্রামের বাড়ি সনদ্বীপ উপজেলায়। তার মা একজন শিক্ষিকা বলে জানা গেছে।ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদকে। নৃশংস কায়দায় তাকে হত্যা করার পর চোখ উপড়ে লাশ ফেলে রাখা হয়। যা দেখে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অাঁতকে উঠেছে। রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি আবিদ শান্তশিষ্ট স্বভাবের ধার্মিক এক তরুণ। যার মৃত্যুতে তার পরিবার পরিজন, এলাকাবাসী সহ সবাই শোকে বিহবল হয়ে পড়ে। সবার জিজ্ঞাসা কেন এই ছেলেকে রাজনীতির প্রতিহিংসার বলি হয়ে নিমর্মভাবে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো।

শহীদ ভাইয়ের রক্তের সাথে বেঈমানী করতে পারবে না বলে জননীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছিল মঙ্গলবার ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদ বিন ইসলাম। ওইদিন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মাকে আবিদ বলেন, তার ছেলে যদি কখনো শহীদ হয়ে যায়, শহীদের মা হিসেবে যেন তিনি চলেন। গত মঙ্গলবার হরতালের প্রথমদিনে চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাট এলাকায় সন্ধ্যায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হামলায় নিমর্মভাবে মারা যায় ছাত্রশিবিরের সাথী আবিদ বিন ইসলাম।

আবিদের পিতা এডভোকেট মনিরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, তার ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। আবিদের শরীরে দুইটি গুলীর দাগ দেখা যায় আর চোখ দুইটি উপড়িয়ে ফেলা হয়। তার ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে হত্যার পর লাশ ফেলে দেয়। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধারের নামে নাটক সাজায় বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আবিদের শরীরের বিভিন্নস্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতও দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর নতুন এ ব্লক এলাকায় ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। আবিদ ফেইসবুকে নিজেকে ইসলামের জন্য কবুল করার আবেদন করেন পরম করুণাময়ের কাছে। তার ইচ্ছা আল্লাহ তায়ালা পূরণ করেছেন বলে জানান আবিদের গর্বিত পিতা এডভোকেট মোঃ মনিরুল ইসলাম।

আবিদের পিতা এডভোকেট মোঃ মনিরুল ইসলাম বলেন, আবিদের চোখে ছিল মায়াবী আকর্ষণ। দশম শ্রেণীতে তিনি ছাত্রশিবিরের সাথী হয়। তিনি ছাত্রশিবিরের সর্ব কনিষ্ট সাথী বলে পিতা মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান। তার দুই ছেলের মধ্যে আবিদ ছোট। আবিদ নামাযের ইমামতি করতেন আর পিতা ও বড় ভাই তার পিছনে নামায আদায় করতেন। চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্র। আবিদ বিন ইসলামের গ্রামের বাড়ি সনদ্বীপ উপজেলায়। তার মা একজন শিক্ষিকা বলে জানা গেছে।

 

শিবিরের সন্ত্রাস--প্রশ্নবিদ্ধ কি পুলিশ বিভাগ?


ফারুক যোশী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি : জনি /বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঐতো ক‘মাসই হলো বিশ্বজিতের নৃশংস হত্যার। সারা জাতি কি রক্তের ঐ চিহ্ন আজও মন কিংবা স্মৃতি থেকে ভুলে যেতে পেরেছে ? যাদের ন্যূনতম বিবেকবোধ আছে, হত্যা-নির্যাতন দেখলে যারা বিচলিত হয়, তাদের জন্যে বিশ্বজিতের হত্যা ঘুম হারাম করার মতো একটা ব্যাপার। টিভি‘র এই ফুটেজ দেখে এখনও অনেক মানুষ ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখেন, আঁৎকে ওঠেন। কি বীভৎস হত্যার মহড়া এটা এবং মহড়া দিতে দিতেই ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত করে এই তরুণকে পরপারে পাঠিয়ে দেয়া।

বিশ্বজিতের খুনি কারা ? এটা জানতে কি প্রশ্ন করতে হবে কাউকে? যাদের নাম এসেছে, তাকে কোপানোর চিত্র যারা দেখেছে তাদের সামনে সব কিছুই পরিষ্কার। সরকার জানে, প্রশাসন জানে। তাই তো ধরা পড়েছে বিশ্বজিতের হত্যাকারী।
এই হত্যাকারীদের মাঝে যাদের নাম এসেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। নাম এসেছে ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসন কিংবা সরকার দায় বাঁচাতে বলতেই পারে, এ সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগের নয়। এরা বহিষ্কৃত। কিন্তু বললেই দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায় ?

বিশ্বজিতের রক্তের দাগ শুকায় নি এখনও। কিন্তু ছাত্রলীগ ঠিকই আছে। ছাত্রলীগ-ছাত্রদল লড়াই তো আছেই। সিলেটের শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস পুড়িয়ে উল্লাস করেছে কারা ? টিভি‘র ফুটেজ কিংবা মিছিলের চিত্র জানিয়ে দিয়েছে তা দেশের জনগণকে। আগের বছরের কথাগুলো না হয় বাদই দিলাম। তাদের ভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে পুড়ছে যেন সারা দেশ।  আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতে রক্তাক্ত লড়াইয়ে তারা নিজেরাই মরছে।
তাদের নিজেদের দ্বন্দ্বে এমনকি মরতে হয়েছে নিষ্পাপ দশ বছরের শিশু রাব্বিকে, ময়মনসিংহে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করেন রাজনীতির বিকারে আচ্ছন্ন কিছু বিকারগ্রস্ত শিক্ষক কিংবা ভিসি। এরা লেলিয়ে দেন ঐ ছাত্রলীগকে। আর তাইতো ভিসি‘র পক্ষ নিয়ে ছাত্রলীগ তাদের শিক্ষকদের উপর এসিড মেরেছে, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতিতে নাকি ভিসি‘র পক্ষাবলম্বন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাণ্ডব ঘটিয়েছে ---এমনকি শিক্ষকদের উপরও। এ ঘটনাগুলো জাতিকে শুধু লজ্জাই দেয় না, গোটা শিক্ষাব্যস্থাকেই করে তোলে প্রশ্নের মুখোমুখি।

স্বাভাবিকভাবে তাই ছাত্রলীগ আজ প্রশ্নবোধক। মহাজোট সরকারের ঘরের শত্রু এখন ছাত্রলীগ--- যেন রামায়নের উল্লেখিত রাবণের ছোটভাই বিভীষণ। এই অসংখ্য বিভীষণই যেন বধ করছে আওয়ামী লীগকে। মহাজোট সরকারের উল্লেখযোগ্য  সফলতাকে ম্লান করে এরাই সরকারের জনপ্রিয়তাকে টেনে নামাচ্ছে শূন্যের অতলে।

২) এই ছাত্রলীগ যখন বিশ্বজিতকে কুপিয়ে মারছিলো তখন পুলিশের তরুণ বড় অফিসার তা দূর থেকে দেখছিলেন, তার সম্মুখেই না-কি বিশ্বজিতকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। এই অফিসার সংসদের বিরোধী দলীয় চিফ হুইপকে পিটিয়েছেন। সে চিত্রও দেখেছে বাংলাদেশের জনগল।
কিন্তু ঐ হারুনই পেয়েছেন প্রেসিডেন্ট পদক (পিপিএম)। সবচেয়ে বিস্ময়ের সাথে আমাদের শুনতে হয়েছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সেই কথাটি ‘জয়নুল আবেদীন ফারুককে মারার ঘঠনাটিও’ না-কি তার পদক প্রাপ্তির বিবেচনায় স্থান পেয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ কথাটি তো কোনো ভব্যতা বা শিষ্টাচারের সাথে যায় না। কারণ বিরোধীদলের চিফ হুইপকে ‘পিটানো‘ শব্দটা মোটেও পজিটিভ কোনো শব্দ নয়।
যদিও জনাব ফারুকের ঐদিনের ভিডিও ফুটেজটি আমাদের আশাহত করেছে। তার কথাবার্তায় সংসদ সদস্য সুলভ আচরণ পরিলক্ষিত ছিলো না। হারুনের অন্য কোনো অবদান থাকতেই পারে পুলিশ বিভাগে, তা বিবেচনায় নিতেও পারে তাদের বিভাগ। কিন্তু সেজন্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটা সমালোচিত-নিন্দনীয় ঘটনার পক্ষ নেবেন, এটাতো আমরা আশা করতে পারি না।

৩) সোমবার বাংলাদেশে হয়ে গেছে আরেক তাণ্ডব। ইসলামী ছাত্রশিবির তাণ্ডব চালিয়েছে সারা বাংলাদেশে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটককৃত নেতাদের মুক্তির দাবীতে তারা বিক্ষোভের নামে চালিয়েছে এ তাণ্ডব। সারা দেশের প্রত্যেকটি জেলায় এমনকি উপজেলায় একযোগে পুলিশের উপর হামলা, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ গুলি বিনিময় প্রভৃতিতে সারাটা দেশ যেন এক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিলো। এমনকি অর্থমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত গাড়িটিও রক্ষা পায় নি। এর আগেও আমরা দেখেছি পুলিশের উপর হামলার চিত্র। এবারেও দেখেছি গাড়ি পোড়ানোর দাউদাউ আগুন। শত-সহস্র শিবিরকর্মী পুলিশের উপর হামলে পড়েছে।
পুলিশ কি করলো! এর আগের দিন ঢাকার পুলিশ কমিশনার বললেন শিবির পেলে গুলির নির্দেশ দেবেন। পুলিশ কমিশনারের এরকম উক্তি বরং শিবিরকর্মীদের আরও মারমুখি। অথচ বাস্তবতা কি ছিলো ? সরকার বলতে গেলে ছিলো সহনশীল। পুলিশ মার খেয়েছে। ৩০ জন পুলিশ আহত হয়েছেন এরমাঝে গুলিবিদ্ধ অফিসাররাও আছেন।
বামপন্থিদের অহিংস হরতালে পুলিশ মরিচ (পিপার)স্প্রে ব্যবহার করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিলো মিছিলকারী কিংবা মানববন্ধনকারী কর্মীদের। আমরা বলি না শিবিরের বিক্ষোভে পুলিশ স্প্রে ব্যবহার করুক,কিংবা গুলি করুক কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তো মনে হয় ভালো কোন উদ্যোগই নিতে পারে নি নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ।

প্রশ্ন জাগে এত গরম কথাবার্তা বলেও তাণ্ডব থামাতে পারলো না কেন পুলিশ। লালবাগের ডিসি একজন হারুন একজন ফারুককে পেটাতে পারেন। কিন্তু হারুন কিংবা সেই ডিসি যিনি বলেছিলেন গুলি করবেন, তারা কি করলেন। গুলি আমরা চাই না।
কিন্তু দু‘শ গাড়ি বাঁচাতে পারলো না কেন পুলিশ। তাদের সতীর্থদের গুলি থেকে বাঁচাতে পারলো না কেন তারা। প্রধানমন্ত্রী সচিবালয়ে অবস্থানকালে তারই পাশাপাশি জায়গায় বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হলো। অর্থমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রদানকারী গাড়িটি হামলার শিকার হলো, নিরাপত্তা পুলিশ সমদস্যও আহত হলেন। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, গোয়েন্দা বিভাগ এর আগে থেকেই এসব জানতো, সেজন্যেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিলো।
এমনকি পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদও সে কথাটারই প্রতিধ্বনি করলেন, কিন্তু আগাম তথ্য জানা সত্ত্বেও কেন তারা ব্যবস্থা নিতে পারলো না, সে উত্তর দিতে পারেন নি।
এমনকি মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ২১ টি বোমা বিস্ফোরিত হলো। সোমবারের সন্ত্রাসী তান্ডবের পর মঙ্গলবার খোদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঘঠলো এরকম বোমা হামলা। প্রশ্নতো আসবেই গোয়েন্দা বিভাগ কি করে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ছাত্রলীগকে যে পুলিশ পাহারা দেয় বলে একটা কথা প্রচলিত আছে, সেই পুলিশই ছাত্র শিবিরকেও কি পথ করে দেয়------ পুলিশ পেটানোর কিংবা গাড়ি পোড়ানোর মওকা পায় কিভাবে তারা। এবং লাগাতার চালিয়ে যাচ্ছে তাদের তাণ্ডব।

আর এখানেই ছাত্রলীগ আর ছাত্র শিবিরের মাঝে কোন তফাৎ নেই। ভিন্নতা নেই এমনকি পুলিশের মাঝেও। ছাত্রলীগ পাহারা দিতে যেমন পুলিশ আছে, সেভাবে ছাত্রশিবির পাহারা দিতেও কি পুলিশ থাকে ? এ প্রশ্নটি আমাদের নতুন করে ভাবনা জাগায়। তাহলে গোয়েন্দা বিভাগ কি ব্যর্থ? অর্থমন্ত্রী কিন্তু সেরকম কথা-ই বলেছেন।
না-কি নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত কোনো গ্রুপ এ সহিংসতার পথ করে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্নটা আসতেই পারে পুলিশ বিভাগেও কি জামাত-শিবিরের বাহিনী ঘাপটি মেরে বসে আছে।

সেজন্যে আমরা মিলিয়ে নিতে চাই ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের সাথে শিবির সন্ত্রাসীদের। সন্ত্রাসীদের কোনো জাত নেই, অন্য কোনো পরিচয় নেই। এরা ছাত্রলীগ করলেও সন্ত্রাসী, শিবির করলেও সন্ত্রাসী। শুধু সন্ত্রাসের মাঝে তফাৎটা একটা জায়গায়। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস করে টেন্ডার আর চাঁদাবাজি নিয়ে, কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবে লাইমলাইটে আসার জন্যে। আর শিবির সন্ত্রাস করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বাঁচানোর জন্যে। শিবিরের বরং তার একটা নিজস্ব ‘আদর্শ’ কাজ করে। শিবির তাদের রাজনৈতিক দর্শন (!) কামিয়াব হওয়ার লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছে ঐ গোলাগুলি আর পোড়ানোর সংগ্রাম, দিতে চাচ্ছে মরণ কামড়।
যে যেভাবেই চালাক না কেন, এই সন্ত্রাস দেশটাকে দিন দিন নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের শেষ সময়ে এসে বিভীষণদের বাড়াবাড়ি দেশজুড়ে আওয়ামী লীগবিরোধী সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি শিবির সন্ত্রাসীরাও সুযোগ নিচ্ছে একের পর এক। আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। তাই ঐ বিভাগকে নিয়েই ভাবতে হবে। গোটা বিভাগটাকেই যেন ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। কে কিভাবে ব্যবহার করছে সরকারের ঐ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটি, কোন কলকাঠি কি নড়ছে কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়, তা এখন ভেবে দেখার সময়। দমন করতে হবে শিবির সন্ত্রাসীদের, বন্ধ করে দিতে হবে ধর্ম নিয়ে খুন-খারবির রাজনীতি, রুখতে হবে ছাত্রলীগ নামক বিভীষণদের।
ফারুক যোশী: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Faruk.joshi@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৪স ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০১৩
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর






ঢাকা: বাচ্চু রাজাকার আর অভিযুক্ত নন, দোষী সাব্যস্ত হওয়া একজন খুনি, ধর্ষক ও অপহরণকারী। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো এখন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১২ জনকে হত্যা, তিন নারীকে ধর্ষণ ও একজনকে অপহরণ করে নির্যাতনের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে।

১৯৭১ সালের ১৪ মে ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার কলারন গ্রামের জমিদার সুধাংশু মোহন রায়কে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকার। এর দুইদিন পরে ১৬ মে বাচ্চু রাজাকার সালথা থানার (সাবেক নগরকান্দা) পুরুরা নমপাড়া গ্রামের মাধবচন্দ্র বিশ্বাসকে গুলি করে হত্যা করেন। পরের দিন ১৭ মে আযাদ ৩০-৩৫ জন রাজাকারকে নিয়ে বোয়ালমারীর হাসামদিয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় নির্বিচারে গুলি ছুড়ে ঘটনাস্থলে ৭ জনকে ও ধরে নিয়ে গিয়ে পরে গুলি করে আরও দুইজনকে হত্যা করেন তিনি। এরপর ৩ জুন সালথা থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামের হিন্দুপাড়ায় লুটপাট শেষে গুলি করে হত্যা করেন চিত্তরঞ্জন দাসকে।

এছাড়া বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে ধর্ষণের অভিযোগও। ৮ জুন বাচ্চু রাজাকার ও তার চার-পাঁচজন সহযোগী বোয়ালমারীর নতিবদিয়া গ্রামের এক হিন্দু বাড়িতে দুই নারীকে গণধর্ষণ করেন। এর আগে ১৮ মে সালথা থানার উজিরপুর বাজারপাড়া গ্রামের এক সংখ্যালঘু তরুণীকে অপহরণ করে আটকে রেখে নির্যাতন করেন।

এছাড়া একাত্তরের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদপুর শহরের খাবাশপুর থেকে রণজিৎ নাথ ওরফে বাবুনাথকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করেন। 

 

 

 কারাগারে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতন

খুনি, ফাঁসির আসামিদের সেলে রাজবন্দীরা; কবরসদৃশ সেলে উচ্চ আলোয় চোখ ঝলসে দেয়া হচ্ছে
মনির হোসেন
তারিখ: ২৪ ডিসেম্বর, ২০১২

কারাগার
দুর্ধর্ষ খুনি, ফাঁসির আসামি ও জঙ্গিদের রাখার জন্য নির্মিত কাশিমপুরের কড়া নিরাপত্তার টর্চার সেলে আটক রাখা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে কারারুদ্ধ বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের। সঙ্কীর্ণ সেলে গাদাগাদি করে রাখা নেতাকর্মীদের মাথার ওপর ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হাই ভোল্টেজ বৈদ্যুতিক বাল্ব। দম বন্ধ হওয়া কবরসদৃশ সেলে আটক বন্দীদের অনেকেরই চোখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে চোখধাঁধানো আলোয়। রাতের পর রাত নির্ঘুম থেকে, না খাওয়ার কষ্ট সইতে সইতে বন্দীদের অনেকের মরণদশা। শুধু এ কারাগারই নয়, দেশের প্রতিটি কারাগারেই রাজবন্দীদের আটকে রেখে চালানো হচ্ছে অমানুষিক নির্যাতন।
অভিযোগ রয়েছে, এসব কারাগারে নেতাকর্মীদের স্বজনদের জিম্মি করে নগদ অর্থ আদায় ছাড়াও বিভিন্ন কায়দায় সুযোগ-সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেন কারা প্রশাসনের লোকজন। যারা অর্থ দিচ্ছেন না তাদের বন্দী স্বজনদের ওপর চালানো হচ্ছে নির্যাতন। আবার কাউকে কাউকে বিনা কারণে বিচারের জন্য হাজির হতে হচ্ছে মামলার টেবিলে।
এ দিকে সারা দেশে রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা বৃদ্ধির সাথে সাথে গণহারে গ্রেফতারের ঘটনা বাড়ছেই। বর্তমানে দেশের একমাত্র মহিলা কারাগারসহ ৬৮ কারাগারে বন্দীর সংখ্যা লক্ষাধিক। এসব কারাগারে ধারণক্ষমতা ২৭ হাজার, অর্থাৎ একজনের জায়গায় থাকছেন চারজন। রাজবন্দীদের সেলে এ চিত্র আরো ভয়াবহ। একজনের জায়গায় পাঁচ থেকে ছয়জনকে রাখা হচ্ছে। এতে বন্দীদের দিন কাটছে মানবেতরভাবে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ এসব বন্দীর জন্য থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছে না। নেই গরম কাপড় ও শোবার ব্যবস্থা। প্রচণ্ড শীতে মেঝেতেই পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে রাত কাটাচ্ছেন তারা। বন্দীদের বেশির ভাগই জ্বর, সর্দিকাশিসহ জটিল সব রোগে আক্রান্ত। পর্যাপ্ত ওষুধ থাকলেও তা বন্দীদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে না। আর প্রচণ্ড শীতে বন্দীরা কাবু হয়ে পড়লেও তাদের পুরনো দুর্গন্ধযুক্ত ছেঁড়া কম্বল ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে, যেগুলো ধোয়া হয়নি কয়েক বছর। মলমূত্র মাখা নোংরা কম্বলও ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের সাথে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পুরো দেশ। এ ঘটনা পুঁজি করে পুলিশ গণহারে ধরপাকড় অভিযান শুরু করে। এ অভিযান থেকে রক্ষা পাননি সাধারণ মানুষও।
ভুক্তভোগী ও পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর, গাড়ি পোড়ানোসহ বিভিন্ন অভিযোগে গত দুই মাসে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের ১০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগকেই বিভিন্ন মেয়াদে কারা ভোগ করতে হচ্ছে। অনেককে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ বন্দী বাড়ছে : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা নয়া দিগন্তকে জানানÑ বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের যত আসামি কারাগারে আসছেন এক রাত রেখেই পরদিন তাদের সবাইকে কাশিমপুর কারাগার-২ ও কাশিমপুর সেন্ট্রাল কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেন পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এটি সরকারের ওপরের নির্দেশ। সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত কয়েকজন  ছাত্রীকেও পাঠানো হয় কাশিমপুর মহিলা কারাগারে। কারা সূত্রে জানা গেছে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আট হাজার বন্দী অবস্থান করছেন। এসব বন্দীর মধ্যে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেফতারকৃতদের সাথে করা হচ্ছে বৈষম্যমূলক আচরণ। তাদের সেলে শীতের কাপড় বা কম্বল দেয়া হচ্ছে না। নেই গরম পানির ব্যবস্থা। এসব রাজবন্দী শীতের মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ছেঁড়া কম্বল দিয়ে তারা কোনোমতে শীত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছেন। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শীতে। নিয়মানুযায়ী চিকিৎসা দেয়ার কথা থাকলেও ডাক্তার যাচ্ছেন না তাদের কাছে। সাধারণ বন্দীরা ১০ হাজার টাকা করে দিয়ে হাসপাতালে বদলি হওয়ার সুযোগ পেলেও রাজবন্দীদের তা-ও দেয়া হচ্ছে না। ভাতে পাথর মিশিয়ে খেতে দেয়া হচ্ছে। আটার যে রুটি খেতে দেয়া হয় তা টেনে ছেঁড়া দায়। বন্দীদের অনেকেই উপোস থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রাণ বাঁচাতে যারা খাচ্ছেন, তারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।
টর্চার সেলে রাজবন্দী নির্যাতন : কাশিমপুরের কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর সেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এই কারাগারে বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের বেশির ভাগ নেতাকর্মীকে আটক রাখা হয়েছে। কারাগারটি মূলত তৈরি করা হয়েছে ফাঁসির আসামি, জঙ্গি ও দুর্ধর্ষ অপরাধীদের জন্য। কিন্তু সরকারের ওপরের মহলের নির্দেশে কারা কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এ কারাগারে রাখার ব্যবস্থা করছে। ছয়তলা ভবনের এই কারাগারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেলগুলো একেবারেই ছোট। ছাদের উচ্চতাও কম। ভেতরে আলো-বাতাসের কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেকটা কবরের মতো। একজন বন্দী কোনোভাবে কষ্ট করে থাকতে পারেন। কিন্তু সেখানে কোনো কোনো সেলে দু-তিনজন করে রাখা হয়েছে। হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক বাল্ব মাথার সাথে লেগে যায়। আলোর পরিবর্তে এ বাতি যন্ত্রণা। বাতির আলোয় অনেকেরই চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সেল থেকে বের করা হলে আটকেরা দীর্ঘক্ষণ চোখে কিছুই দেখতে পান না। মানসিকভাবে নির্যাতন করতেই এ ব্যবস্থা। অভিযোগ রয়েছে, বন্দীদের দেখা-সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে সব কিছুতেই স্বজনদের অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে।
ওই কারাগারের এক রক্ষী এ প্রতিবেদককে বলেন, কাশিমপুর কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আবদুর রাজ্জাকের নির্দেশে ভেতরে চলছে লুটপাট। ছয়তলা ভবনের নিচতলায় মশার উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। যারা নিচ থেকে ওপরের তলায় যেতে চান, তাদের প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। এ ছাড়া নিয়ম মোতাবেক বন্দীর স্বজনেরা দেখা-সাক্ষাৎ করতে এলে প্রত্যেককেই অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়। শীতের কম্বল দেয়া হলেও কম্বলগুলোর বেশির ভাগই ছেঁড়া ও দুর্গন্ধযুক্ত। ধোয়া ছাড়াই এসব কম্বল ব্যবহারে অনেকেই খোসপাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগে ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন। শুধু হাই সিকিউরিটি সেল নয়, একই অবস্থা বিরাজ করছে অন্যান্য কারাগারেও ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে রাজবন্দীদের নিয়ে কারা প্রশাসন অলিখিত ব্যবসা শুরু করেছে।
শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার আর কাশিমপুরের ১ ও ২ হাই সিকিউরিটি এবং মহিলা কারাগার নয়, দেশের ৬৮টি কারাগারেই এখন চলছে লুটপাট। এসব দেখেও কারা প্রশাসন নির্বাক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও তেমন একটা মনিটরিং না থাকায় অনেক কারাগারের জেলসুপার বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। ইতোমধ্যে কিছু কর্মকর্তা বন্দী ও স্বজনদের সুযোগ-সুবিধাসহ নানা কায়দায় শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছেন : আইজি প্রিজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বরাবরের মতোই টেলিফোন ধরেননি।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সেন্ট্রাল কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার আবদুর রাজ্জাকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার কারাগারে কোনো রাজবন্দী নেই। বিএনপি, জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ঢাকা থেকে এ কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না না এখানে শিবিরের কিছু এসেছিল তারা জামিনে বের হয়ে গেছে। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মূলত এই কারাগার হচ্ছে ফাঁসির আসামি, হেরোইনসেবী, হরকাতুল জিহাদ ও দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীদের জন্য। দুর্নীতি ও অনিয়মের কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, এখন প্রত্যেক বন্দীকে কম্বল দেয়া হয়েছে। কারাগারের সেলগুলো ছোট ছোট এবং বন্দীদের নানা কায়দায় টর্চার করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব কথা আসলে বাইরের লোকেরা বলেন। আমার কারাগারটি ইউনিভার্সিটির হলের মতো। রয়েছে ফ্যান-লাইট আর লাগোয়া বাথরুম। রয়েছে হাঁটাহাঁটির জন্য ব্যালকনিও। তা ছাড়া সামনে বিরাট মাঠে রয়েছে ঘোরাঘুরির সুযোগ। তাহলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বিএনপি, জামায়াত-শিবিরের যাদের পাঠানো হচ্ছে, তাদের কোথায় পাঠানো হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানি না। তবে তারা আমার কারাগারে আসছে না।






 চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল। দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক জনপদ। প্রকৃতির খেয়ালের ওপর ভর করে চলে এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। তার ওপর জলেস্থলে দস্যুদের অতর্কিত হানা এখানকার মানুষকে রাখে চরম অনিরাপত্তায়। পুরোটাই এক সন্ত্রাসের উপকূল। এই বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এক পক্ষকাল চষে বেড়িয়েছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও ফটো করেসপন্ডেন্ট উজ্জ্বল ধর। সেখান থেকে তুলে এনেছেন সন্ত্রাসের ওই জনপদের অনেক সচিত্র কাহিনী। এ বিষয়ে (উপকূলের অপরাধ) ধারাবাহিক প্রতিবেদনের জন্য তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শ্রেষ্ঠ পুরুস্কার পান।আজ তার প্রথম কিস্তি....  
 

ছবিতে লালবৃত্তে চিহ্নিতরা নিজাম ডাকাতের সহযোগী। ছবি: উজ্জ্বল ধর/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
জঙ্গল কাইটা এই অঞ্চল ‘স্বাধীন’ করছি : নিজাম ডাকাত
পুরো নাম নিজাম চৌধুরী। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও ভোলার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল, উদার মেঘনার বিশাল সীমারেখা ছাড়িয়ে গভীর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া ত্রাসের এক নাম ‘নিজাম ডাকাত’।

টানা ১৪ দিন চরাঞ্চলে ঘুরে তিনদফা শিডিউল করেও শেষ পর্যন্ত নিজাম চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয় টেলিফোনে। তবে সেটি নিজামের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড বাহার কেরানীর মোবাইল ফোনে। এর আগে সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী ও থার্ড ইন কমান্ড করিম ফিটার বাংলানিউজের এই প্রতিবেদককে ঘুরিয়ে দেখান নিজাম চৌধুরীর বিশাল ‘সাম্রাজ্য’।   

নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জঙ্গল কাইটা এ অঞ্চল স্বাধীন করছি।’

শুরুতেই তিনি স্মরণ করেন তার নেতা বাসার মাঝির কথা। তিনি বলেন, বাসার মাঝি আমাদের মুরুব্বি ছিলেন। তিনি এ অঞ্চলের ভূমিহীনদের চরে আশ্রয় দিছিলেন। চরের নোনাবন, ক্যাপড়া (কেওড়া), গোয়া (গেওয়া) কাইটা এ অঞ্চলে মানুষের শাসন প্রতিষ্ঠা করছি। সুদিনে (শুকনা সময়) এইহানে অনেকে আয় (আসে) যায়। কিন্তু দুর্দিনে (বর্ষাকালে) এইহানে কেউ আয় না (আসে না)।

বাসার মাঝি ভূমিহীনদের একদাগ কইরা (১৬০ শতাংশ) জমি দিয়েছিলেন জানিয়ে নিজাম অভিযোগ করে বলেন, ‘হাতিয়ার এমপি আজিম সাব (ফজলুল আজিম), নোয়াখালির এমপি একরামুল হক চৌধুরী ও হাতিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান অলি মিয়া র‌্যাব দিয়া বাসার মাঝিরে খুন করাইছে।’

‘র‌্যাব বাসার মাঝিরে জীবিত ধরছিল। তারে তাজা নিতে চাইছিল। ৫০/৬০ হাজার মানুষ বাসার মাঝিরে ছাড়াইয়া আনতে গেছিল। কিন্তু আজিম সাব এবং একরাম চৌধুরী অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে বাসার মাঝিরে র‌্যাবরে দিয়া গুলি কইরা মারছে’, বলেন নিজাম চৌধুরী।

তিনি বলেন, শেষ জীবনে বাসার মাঝি ভালো হইয়া গেছিলেন। তিনি কোন রাজনৈতিক নেতারে পাত্তা দিতে চাইতেন না। তিনি ভূমিহীনদের সমাজ গড়ে তুলছিলেন। পাঁচটা চরে ৪৫টি স্কুল, ৪৫টি মাদ্রাসা ও ৪৫টি মসজিদ গড়ে তুলছিলেন। বাথানখালিতে একটি হিন্দু মহল্লা গইড়া তুলছিলেন। মন্দির বানাইয়া দিছিলেন। এসবই করেছেন নিজের টাকায়। আমরা এখন এইগুলা নিজের টাকায় চালাইতাছি।’

‘বাসার মাঝি খুন হওয়ার পর নাসির কেরানী (এক সময় বাসার মাঝির সেকেন্ড ইন কমান্ড) আজিম সাব, একরামুল হক চৌধুরী, অলি মিয়া ও মওদুদ আহমেদের মদদে চরে খুন, গুম, ডাকাতি, ধর্ষণ, লুট, ও নারী নির্যাতনের মাধ্যমে অস্থির অবস্থা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে আমি (থার্ড ইন কমান্ড) নাসিরের কাছ থেকে দূরে সরে আসি এবং নাসিরের অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ সময় সন্দ্বীপের খোকা বাহিনীকে সাহায্য করেন মওদুদ আহমদ। খোকা মওদুদকে ধর্মের বাপ বলে। খোকা এবং নাসিরকে সাহায্য করে সন্দ্বীপের এমপি মোস্তফা কামাল পাশা। নাসিরের সহায়তায় খোকা উড়িরচরে ঘাঁটি গাড়ে,’ বলতে থাকেন নিজাম।

তিনি বলেন, ‘এ দুই বাহিনীর অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে আমার হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। আমি এমনি এমনি শখ কইরা অস্ত্র হাতে নেই নাই। আপনারা সাধারণ মানুষরে জিজ্ঞেস করেন, কেউ আমারে ডাকাত বলবে না। সাধারণ মানুষ এখন ভালো আছে। শান্তিতে আছে।’

নিজাম চৌধুরী বলেন, ‘নাসির কেবল অত্যাচারই করত না। বাসার মাঝির বানানো স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদেও তালা দেয়। হাজার হাজার শিশু পড়া ছাইড়া বাড়িতে বইসা থাকত।’

‘আমি কোনো রাজনৈতিক নেতারে সালাম দেই না, তাই তারা আমারে বাহিনী প্রধান বা ডাকাত বলে সাব্যস্ত করে। এই কথাডা কেউ তুলে ধরে না, লিখে না। সবাই আমারে ডাকাইতই বলে। রাজনৈতিক নেতারা আমার কাছে টাকা চায়। মাসোয়ারা চায়। আমি টাকা পাই কই! আমি গরীব মানুষের নেতা। ভূমিহীনদের বন্ধু। সাধারণ মানুষ আমার হাতে অস্ত্র তুলে দিছে। আমি সেই অস্ত্র তাদের জানমালের নিরাপত্তায় ব্যবহার করছি।’

‘দেখেন আমরা আওয়ামী লীগ করি। বিএনপির শাসনামলে আমরা এ এলাকার নাম- মুজিব বাজার, হাসিনা বাজার রাখি।  বর্তমানে মুজিব বাজারে মুজিবনগর উপজেলা করার দাবি জানিয়েছি। বিএনপির অত্যাচার সহ্য করছি। তারা আমাদের অমানুষিক অত্যাচার করছে। এখন আমাদের দল ক্ষমতায়। এখনো আমরা অত্যাচারিত। যখন তখন র‌্যাব-পুলিশ চরে হানা দিয়ে আমাদের অত্যাচার করে। ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দেয়, পুড়াইয়া দেয়। চরের সাধারণ ভূমিহীনদের ধইরা বাহিনীর সদস্য বইলা মারধর করে।’

তবে চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো ভিন্ন এক চিত্র। তারা জানালেন-

নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সন্ত্রাসের জনপদে বর্তমান একাধিপতি নিজাম বাহিনীর প্রধান এই নিজাম ডাকাত।

বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলসহ মেঘনায় এ অববাহিকায় নিজাম বাহিনীর বন ও জলদস্যুপনায় জনজীবনে চরম ভোগান্তি নেমে এসেছে। সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার চরাঞ্চলে দুই সপ্তাহের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে নিজাম বাহিনীর উৎপাতে জেলে পারিবারসহ সাধারণ মানুষ দিশাহারা।

মেঘনার ‘জলদস্যু সম্রাট’ জাহাঙ্গীর মাঝি, নব্বা চোরা, বাশার মাঝি, মুন্সিয়া চোরা, কালা বাদশা, ইব্রাহীম ডাকাত, জয়নাল স্পিকার, সুমন বাহিনী, পিচ্চি খোকা, নাছির বাহিনী, মিয়া শিকদার ও গেস্যা ডাকাত অধ্যায় শেষ হওয়ার পরপরই নতুন করে শুরু হয়েছে নিজাম বাহিনীর এ অধ্যায়। এ বাহিনীর আধিপত্য শুধু হাতিয়া নয় মনপুরা, সন্দ্বীপ, লক্ষ্মীপুরের রামগতিসহ বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে।

স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, নোয়াখালী জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা ও গডফাদার হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীই এখন দেখভাল করেন নিজাম বাহিনীকে।

জেলেদের অভিযোগ এ বাহিনীর হামলা, লুটপাট, হত্যা, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, ডাকাতি ও জিম্মি করে মুক্তিপণ, নারী ধর্ষণ, চরদখলসহ নানা কর্মকাণ্ডে উপকূলীয় জেলে সম্প্রদায় ও সাধারণ ভূমিহীনরা এখন নিজাম বাহিনীর কাছে জিম্মি।

স্থানীয় জেলে ও ভূমিহীনরা জানায়, গত এক মাসে জলদস্যুরা এ অঞ্চল থেকে অন্তত শতাধিক ট্রলারসহ ৫ শতাধিক মাঝিমাল্লাকে চাঁদার দাবিতে অপহরণ করে পরে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়। আবার অনেককেই হত্যা করে নদীতে নিক্ষেপ করে। যার সংবাদ অজানাই থেকে গেছে দেশবাসীর।

হাতিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘৯০ দশকের প্রথম দিকে নদীভাঙনের কারণে হাতিয়া উপকূলে বয়ারচর, নলেরচর, ঢালচর, ক্যারিংচর, নঙ্গলীয়ারচরসহ বহু নতুন নতুন চর জেগে ওঠে। বনবিভাগ সেখানে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করে। সে সময়ে ওই বনাঞ্চল দখল করে নেয় জল ও বনদস্যুরা। ম্যানগ্রোভ বন দখল করে সবুজ বেষ্টনী নিধন করে ভূমিহীনদের কাছে জমি বিক্রি শুরু করে দস্যুরা। এভাবে সৃষ্টি হয় উপকূলে দস্যু রাজত্ব।’

ক্যারিং চরের স্থানীয় ভূমিহীনরা জানান, ২০১০ সালের ২২ নভেম্বর নঙ্গলীয়ারচরের ভূমিহীনরা ডাকাতিকালে নিজাম ডাকাত ও তার সহযোগী ৩৮ চিহ্নিত জলদস্যুকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পুলিশ আটক জলদস্যুদের ওইদিন ভোররাতে জেলা সদর মাইজদি নেওয়ার পথে চরের চেয়ারম্যান ঘাটে এসে দস্যুদের ছেড়ে দেয়। তখন থেকে জলদস্যু নিজাম ডাকাতের উত্থান ঘটে।

হাতিয়ার সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘বর্তমান নোয়াখালির পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারী দস্যুদের ছেড়ে দেন।’

বিষয়টি পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ মিথ্যা অভিযোগ হিসেবে উল্টো সংসদ সদস্যকে দস্যুতার জন্য দায়ী করেন।

তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য রাজনীতির খাতিরে মিথ্যা তথ্য দেন। কিন্তু আমিতো সরকারের নিরপেক্ষ প্রশাসনের অংশ। কোনো কারণে কার ভোট কমবে এটা দেখার বিষয় আমার না।’

নিজামের উত্থান

নিজাম ডাকাতের আদিনিবাস লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতিতে। সে কয়েক বছর ধরে বসবাস করেছে হাতিয়ার বয়ারচরে। ২০০৩ সালে বন ও জলদস্যু নিধনের সময় সোলেমান কমান্ডারের দস্যুবাহিনীর সদস্য ছিল নিজাম ডাকাত। পরে নিহত চরের সম্রাট হিসেবে খ্যাত বাশার মাঝির সঙ্গে যোগ দিয়ে বিশ্বস্ততা  অর্জন করে। একপর্যায়ে নিজেই দস্যুদের দল গঠন করে। র‌্যাবের হাতে ২০১০ সালের ৬ জুন বাশার মাঝি নিহত হওয়ার পর ‘মুন্সিয়া চোরা’র সঙ্গে নিজামের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় নিজাম ডাকাতের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের ব্যাপক প্রসার ও পরিচিতি ঘটে।

গত বছরের ৬ জুন নিজাম দলের ভাড়াটিয়া দস্যুদের হাতে নিহত হয় মুন্সিয়া চোরা। তারপর নিজাম ডাকাত মুন্সিয়া চোরার সহযোগীদের সংগঠিত করে ও তার বিপুল পরিমাণ অস্ত্রভাণ্ডার নিয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিহত বাশার মাঝির কেরানি ও সেকেন্ড ইন কমান্ড তার প্রতিপক্ষ নাছিরকে সম্প্রতি চর এলাকা থেকে বিতাড়িত করে নিজেই দস্যুসম্রাট বনে যান নিজাম। পুরো চর ও নদী এলাকায় একক আধিপত্য কায়েম করে চরদখল ও চাঁদাবাজিসহ ব্যাপক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করে সে ও তার দল।


শনিবার দ্বিতীয় কিস্তি ...

আতঙ্কে দিন কাটছে উড়িরচরের ৩০ হাজার অধিবাসীর। একদিকে বর্তমানে চরের দখল নিয়ে আছেন নিজাম বাহিনীর উড়িরচর কমান্ডার ইব্রাহীম ব্যাপারী, অন্যদিকে হারানো স‍াম্রাজ্য ফিরে পেতে মরিয়া মাকসুদুল আলম খোকার নেতত্বাধীন খোকা বাহিনী।

প্রায় প্রতিদিনই চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে খোকাবাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড এবং খোকার ছোট ভাই নূরুন্নবী মামুন। অভিযোগ আছে, খোকা বাহিনীকে সহায়তা করছে কোস্টগার্ড এবং র‌্যাব। তবে র‌্যাবের এক গোয়েন্দা সূত্র বাংলানিউজকে বলেন, র‌্যাব এ বাহিনীকে ব্যবহার করছে নিজাম বাহিনীকে ধ্বংস করার জন্য। এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা সফল। যেমন, গত মাসেই সদ্য বিলুপ্ত নাসির বাহিনীর কয়েকজনকে সোর্স হিসেবে ব্যবহার করেছে র‌্যাব। তাদের এ যৌথ আক্রমণে নিহত হয়েছে নিজাম বাহিনীর সে সময়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড জয়নাল ও নিজামের এক দেহরক্ষীসহ তিনজন (ক্রসফায়ারে)।

উল্লেখ্য, র‌্যাব এ অভিযানে মোবাইল ফোন কোম্পানির টাওয়ার করার জন্য ঠিকাদার হিসেবে নিজাম বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সহায়তা চায়।

গত ২ মার্চ কোস্টগার্ড এবং র‌্যাব উড়িরচরে এক অভিযান চালায়। এ অভিযানে কোস্টগার্ডের সঙ্গে খোকা বাহিনীর জিপুল, জাবেদ, সাহেদও অংশ নেয় বলে বাংলানিউজকে জানান উড়িরচরের একজন জনপ্রতিনিধি। যদিও কোস্টগার্ড বিষয়টি অস্বীকার করে।

তবে উড়িরচর পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ নাইম উদ্দিন বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমিও বিষয়টি শুনেছি, কিন্তু এ সময় আমি উপস্থিত ছিলাম না।’

বর্তমানে উড়িরচরে নিজাম বাহিনীর নেতৃত্বে আছে ইব্রাহীম মাঝি, মান্নান ওরফে মনাইয়া, তাহের, মোস্তফা ও রামগতীর জাহাঙ্গীর। এদের স্থানীয় এজেন্ট ইসলাম ব্যাপারী এবং মানিক মেম্বার, বাহার মেম্বার, জাসু প্রকাশ জাইস্যা। এদের হাতে আছে চট্টগ্রামের মাকসুদ বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা শতাধিক আধুনিক অস্ত্র এবং কিছুদিন আগে নাসির বাহিনীর ফেলে যাওয়া ৪৬টি বন্দুক ও এক ট্রাঙ্ক কার্তুজ।

এদিকে এ বাহিনীকে হটাতে প্রস্তুত হচ্ছেন খোকাবাহিনীর খোকা। নাসির বাহিনীর প্রধান নাসির কেরানি র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর বর্তমানে এ বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন খোকা। খোকাবাহিনীর সদর দফতর উত্তর উড়িরচরের খায়রুল আলম চেয়ারম্যানের বনবিভাগের বন কেটে তৈরি ৫০০ একরের খামার বাড়িতে। কিন্তু খোকাসহ দলের বেশিরভাগ সদস্যই এখন আশ্রয় নিয়েছে কোম্পানিগঞ্জের হযরত নিজাম উদ্দিনের (রহ.) মাজারে। এ বাহিনীর বর্তমান সদস্যরা হলেন- উড়িরচরের সোরাব, শাহীন, ছোট্টন, আকতার হোসেন, শাহীন, করিম উল্লাহ ভাসানী, রোবেল, সুমন, আব্দুল হাই, হাফেজ আহাং, মোহাব্বত, কাশেম প্রকাশ জাবেদ, দুলাল ব্যাপারী ওরফে দুলাল মেম্বার, কালাপানিয়ার সিরাজ, নূরুন নবী প্রকাশ মামুন, মিলাদ, মাছুম, উড়িরচরের মাসুদ, নুর আলম, এয়াকুব, নূর নবী, মো. কাশেম, হেলাল উদ্দিন, আকতার, সেলিম, দিলদার, আলাউদ্দিন, ইউসুফ, জসীম, হাসেম, জিপুল, রাসেদ, হাসান, জামাল প্রমুখ।

খোকা বাহিনী সম্পর্কে নিজাম বাহিনীর প্রধান নিজাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘চার দলীয় সরকারের আমলে খোকা সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদকে ধর্মের বাবা ডেকে তার সহযোগিতা নেয়। পরবর্তী সময়ে নাসিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে খোকা পুরো উড়িরচরকে নরকে পরিণত করে।’

উড়িরচরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম আজ নতুন নয়। স্থানীয়দের মতে চরের শুরু থেকেই দু’ বাহিনী গড়ে ওঠে। এ বাহিনীগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় শুরু থেকেই নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামের বিভিন্ন জলদস্যু গ্রুপকে চরে আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু অধিকাংশ সময়ই পরে জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়। যেমন, বর্তমানে উড়িরচরে নিজাম বাহিনীকে নিয়ে গিয়েছিল জাহাঙ্গীর মেম্বার। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হন এবং জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষ ইব্রাহীম ব্যাপারী এ গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নেন।

এলাকাবাসীর মতে, শুরুতে উড়িরচরে খায়রুল আলম এবং আসাদুল হক চৌধুরী ওরফে সাহেব মিয়ার নেতৃত্বে ২টি গ্রুপ গড়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালে জমি দখলকে কেন্দ্র করে উড়িরচরে প্রথম খুন হয় মুক্তিযোদ্ধা মোস্তান শের। এ মামলার আসামি হন বর্তমান চেয়ারম্যান (মৃত) খায়রুল আলম। খায়রুল উড়িরচরে বহিরাগত জলদস্যু এবং সন্ত্রাসীদের মদদ দিতেন। খায়রুল আলমের আদি নিবাস সন্দ্বীপের কালাপানিয়া। উড়িরচরে তিনি বনবিভাগের ৫০০ একর বনভূমি দখল করে খামারবাড়ী গড়ে তুলে বসবাস শুরু করেন এবং এক সময় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে তিনি কখনোই উড়িরচরের ভূমিহীনদের নিজের লোক হিসেবে গ্রহণ করেতে পারেননি।

খায়রুল আলমের বড় ছেলে মাকসুদুল আলম খোকা এখন খোকা বাহিনী (অধুনালুপ্ত) নাসির বাহিনীর প্রধান। খোকা ২০০৪ সালে উড়িরচরে প্রথম পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম শুরু করে। ওই সময় খোকা কোম্পানিগঞ্জের সংসদ সদস্য এবং আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন এবং তার মদদপুষ্ট হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে। এ ছাড়া এ সময় খোকা সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশার সমর্থনও আদায় করেন।

এ সময় সংসদ সদস্যর রোষানলে পড়ে সন্দ্বীপের আওয়ামী লীগ নেতা হারিচ সন্দ্বীপ থেকে উড়িরচরে এসে আশ্রয় নেন। হারিচ উড়িরচরে খায়রুল আলমের বিরুদ্ধে জনগণকে সংঘবদ্ধ করেন এবং একটি গ্রুপ তৈরি করেন। বেশিরভাগ বহিরাগতদের নিয়ে গড়া এ গ্রুপ উড়িরচর থেকে চেয়ারম্যান খায়রুল আলমকে বিতাড়িত করে। পরে কৌশল গ্রহণ করেন খায়রুল আলম। হারিচকে শান্তিচুক্তির কথা বলে ডেকে নেন কোম্পানীগঞ্জের চর এলাহীর চর বালুয়ায়। এখানে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় হারিচকে। যার মামলা নম্বর ১৯/জিআর-১২৭/২০০৬/ কোম্পানীগঞ্জ।

এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয় নিহত হারিচের ভাই জুনায়েদ আলি ওরফে জাবেদ। হারিচ হত্যার ৯০ দিনের মাথায় জাবেদ খুন করে খায়রুল আলম চেয়ারম্যানকে। এ হত্যা মামলাও হয় কোম্পানীগঞ্জে। যার মামলা নম্বর জিআর ২৬৭/২০০৭/ কোম্পানীগঞ্জ। এ হত্যায় সাহায্য করে হাতিয়ার জলদস্যু সম্রাট ও বর্তমান সন্দ্বীপ পৌর মেয়র জাফর উল্লাহ্ টিটুর (এক সময়ের বিখ্যাত টিটু বাহিনীর প্রধান) নৌকার মাঝি। কিন্তু খায়রুল চেয়ারম্যান হত্যা মামলায় প্রকৃত খুনিদের আসামি না করে সাধারণ ভূমিহীনদের আসামি করা হয় বলে অভিযোগ সাধারণ চরবাসীর।

এরপর থেকে খোকা বাহিনী বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আড়াই বছর পর্যন্ত উড়িরচর নিয়ন্ত্রণ করছে। এ বাহিনীকে সহায়তা করেন এক সময়ের বাশার মাঝির কেরানি ও নাসির বাহিনীর প্রধান নাসির। এরপর নিজাম বাহিনীর সঙ্গে নাসির বাহিনীর জাহাইজ্জার চরে কয়েক দফায় বন্দুক যুদ্ধ হয়। এরপর নাসির এ চর ছেড়ে উড়িরচরে আশ্রয় নেয়। নিজাম এখানেও তাকে আক্রমণ করে। এরপর নিজাম চট্টগ্রাম এলাকায় চলে যায় এবং ফেনী ও চট্টগ্রামের সন্ত্রাসীদের নিয়ে নতুন বাহিনী গড়ে তোলার সময় পথে র‌্যাবের হাতে আটক হয়।

উড়িরচর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মানিক মেম্বার (মানিক সওদাগর) বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সারাক্ষণ আতংকের মধ্যে আছি। এক বাহিনী যায় তো আর এক বাহিনী আসে। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সময় হলো, যখন এক বাহিনীকে অন্য বাহিনী হটানোর জন্য লড়াই শুরু করে।’

মোবাইল চার্জ দেওয়া ছাড়া বের হয় না উড়িরচরের পুলিশ
উড়িরচর ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অবস্থিত উড়িরচর পুলিশ ফাঁড়িতে অবস্থান করছেন ২৫ পুলিশ সদস্য। এদের মধ্যে একজন এএসআই, একজন নায়েক এবং একজন হাবিলদার। ভয় ও উৎকণ্ঠায় সময় কাটে তাদের।

এ ফাঁড়িতে থাকা কনেস্টবল জুয়েল ত্রিপুরা বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানকার অবস্থা ভালো না। আমরা সব সময় ভয়ের মধ্যে থাকি। আতংকের মধ্যে থাকি। মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা, জোয়ারভাটা নির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা, সন্দ্বীপ থেকে ২ ঘণ্টার নৌপথে যোগাযোগ মাধ্যম হওয়ায় আমাদের হেল্প করারও কেউ নেই।’

তিনি বলেন, ‘এ কারণে চোখের সামনে কিছু ঘটতে দেখলেও আমাদের কিছু করার থাকে না। কোথাও কিছু ঘটলেও পরে কেউ মুখ খোলে না।’

জুয়েল জানান, এ ফাঁড়িতে তাদের কোনো কার্যক্রমও নেই। কেউ কখনো কোনো অভিযোগ নিয়েও আসে না। মাঝে মাঝে দিনে টহল দিলেও উত্তরচরে খোকা বাহিনীর ঘাঁটি থাকায় সেদিকে যেতে উপরের নিষেধ আছে।

তিনি বলেন, ‘সব সময় এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক থাকে না। ফাঁড়ির বেতার যন্ত্রটিও কতদিন ধরে নষ্ট তা কেউ বলতে পারবে না। ফলে আক্রান্ত হলে সাহায্য করারও কেউ নেই।’

জুয়েল জানান, ২/৩ মাস পর সন্দ্বীপ থেকে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এলেও বছরে ২ বার আসেন সার্কেল কমকর্তা।

তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল মোবাইল চার্জ দেওয়ার জন্যই সন্ধ্যায় বাজারে যাই, আর সকালে বাজারের কাজে। এ ছাড়া ব্যারাকের বাইরে যাই না তেমন।’

অন্য পুলিশ কনেস্টবল আবদুল হালিম বলেন, ‘এটা একটা ভয়ের জায়গা। আমরা এসেছি এখানকার মানুষের নিরাপত্তা দিতে, কিন্তু এখানে আমাদেরই জীবনের নিরাপত্তা নেই।’

ফাঁড়ির দায়িত্বরত এএসআই নাঈম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাইরের অতিরিক্ত ফোর্স এলেই আমরা টহলসহ বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করি। এ ছাড়া এখানকার সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের লড়াই করার মতো শক্তি নেই।’

 তৃতীয় কিস্তি ...

সন্দ্বীপের পশ্চিমে মেঘনা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা চর ‘জাহাইজ্জার চর’। ১০ বছর আগে জেগে ওঠা এ চরের আয়তন আনুমানিক ২০০ বর্গ মাইল। যা প্রতিবছরই বাড়ছে। পুরো চরের ৯০ ভাগই ঘন ম্যানগ্রোভ  জঙ্গল। কেওড়া, গেওয়া, লোনা গাছের সঙ্গে আছে স্থানীয় জাতের কাঁটাজাতীয় ও গুল্ম জাতের গভীর প্যারাবন। জনমানবহীন এ জঙ্গলের মালিকানার দাবি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ এবং নোয়াখালীর হাতিয়ার।

কিন্তু চরের চারপাশে কাদা এবং গাছের শুল থাকায় কোনো জেলার প্রশাসনই যেতে পারে না এ চরে। ফলে এ সুযোগ লুফে নিয়েছে এ এলাকার জলদস্যুরা। এ চরে সদরদফতর স্থাপন করে দস্যুরা শাসন করছে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা জেলার বিস্তীর্ণ উপকূল ও সাগর এবং মেঘনার বুকে জেগে ওঠা বিশাল চরাঞ্চল।

বর্তমানে জলদস্যুদের নেতৃত্বে আছেন নোয়াখালীর সুবর্ণচরের নিজাম চৌধুরী। তার বাহিনীর নাম নিজাম বাহিনী। এ বাহিনী এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করে বয়ার চর, ঢালচর, উড়িরচর, ক্যারিং চর, চর বাসার, চর ইসলাম, চর কালাম, ঠাঙ্গারচর, নিঝুম দ্বীপ, চর এলাহী, সুবর্ণচর, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরাসহ চট্টগ্রাম, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

বাহিনীপ্রধান নিজামের ভাষ্য অনুয়ায়ী, বর্তমানে নিজামের আশ্রয়দাতা হাতিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত নেতা মোহাম্মদ আলী।

মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে জলদস্যুদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ করেছেন সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা, হাতিয়ার সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমসহ এ অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষরা। তবে চারদলীয় সরকারের আমলে ওই সংসদ সদস্যরা আগের বাহিনীগুলোকে মদদ দিয়েছে বলেও দাবি সাধারণের।

এ বাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বী বাহিনী হিসেবে সন্দ্বীপের খোকাবাহিনীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ আছে ফজলুল আজিম এমপি, মোস্তফা কামাল পাশা এমপি, সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ, নোয়াখালীর সংসদ সদস্য একরামুল হক চৌধুরী, বিএনপি নেতা বরকত উল্লাহ বুলুর বিরুদ্ধে।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে টেলিফোনে বলেন, ‘আমি এখন নির্বাচনী এলাকায় আছি। তাই এ বিষয়ে এখন কথা বলা সম্ভব নয়। দুইদিন পর বিস্তারিত কথা বলব।’

বরকতুল্লাহ বুলু ও একরামুল হক চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে গত এক সপ্তাহ ধরে টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তিনি তিনি কল রিসিভ করেননি।

তবে ফজলুল আজিম এমপি অভিযোগ অস্বীকার করে মোহম্মদ আলীকেই জলদস্যুর গডফাদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

জাহাইজ্জার চরের গহীনে রয়েছে নিজাম বাহিনীর সদর দফতার। বিদ্যুতের জন্য এখানে স্থাপন করা হয়েছে সোলার প্যানেল, সঙ্গে আছে জেনারেটর। সন্দ্বীপের সংসদ সদস্যের দাবি, এ চরে জলদস্যুদের কাছে আছে অত্যাধুনিক লেদ মেশিন। অস্ত্র তৈরির কারখানা। জলদস্যুদের আশ্রয় ও বিশ্রামকেন্দ্র, অস্ত্রাগার ও হাজতখানা।

গহীন জঙ্গলে এ সদরদফতর হওয়ায় ওপর থেকে হেলিকপ্টারেও এসব স্থাপনার অস্তিত্ব ঠাহর করা যায় না বলে দাবি হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আক্তার হোসেনের।

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ— প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌ-বাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি কেউই যেতে চান না এ চরে। এ বিষয়ে অভিযুক্ত অধিকাংশেরই দাবি দুর্গম এলাকা হওয়ায় বিশাল এ অরণ্যে প্রবেশ কারো জন্যই সুখকর নয়। তাছাড়া এ চরের চারপাশের বেশিরভাগ অংশে এক থেকে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর কাদা থাকায় অল্প সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের অভিযানও ফলপ্রসূ হয় না।

ভয়ংকর নিজাম বাহিনীর সদস্যরা এ চরে নৌপথে যাতায়াত করা ছোট নৌযান এবং নৌযানের মানুষদের আটক করে নিয়ে আসে চরের গহীনে। এরপর আটককৃতদের মোবাইল ফোন থেকে কল দেওয়া হয় আটককৃতদের পরিবারের কাছে। দাবি করা হয় বিপুল অংকের মুক্তিপণ। আটককৃতদের শরীর থেকে খুলে নেওয়া হয় কাপড়। টাকা দিতে অস্বীকার করলে যে কোনো একজনকে দিয়ে পরিবারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় আটককৃতদের। এরপর বাকিদের টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নেয় পরিবারের সদস্যরা।

এ কাজে মধ্যস্থতা করেন সন্দ্বীপ এবং হাতিয়ার জনপ্রতিনিধিসহ বিশিষ্টজনেরা। এইসব ভদ্র জলদস্যু এজেন্ট সম্পর্কে মুখ খোলেন না কেউই। স্থানীয় সংসদ সদস্য,  উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র, স্থানীয় সাংবাদিক, প্রশাসন, জেলে সর্দার, দাদনদাতা, ইউপি চেয়ারম্যান এমনকি ভুক্তভোগী জেলে, সবার মুখেই একই গল্প।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌরুটে চলাচলকারী মালবাহী (কার্গো) জাহাজের চলচলকারী রুট জাহাইজ্জার চর এবং চর ইসলামামের মধ্যকার সন্দ্বীপ চ্যানেল। এ পথে প্রতিদিন ৩ শতাধিক জাহাজ চলাচল করে। প্রতিটি জাহাজকেই নিজাম বাহিনীকে চাঁদা দিয়ে চলাচল করতে হয়।

এ ছাড়া বঙ্গপোসাগরের মোহনা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে হাজার হাজার জেলেনৌকা এ এলাকায় মাছ ধরতে আসে। এসব নৌকাকে জলদস্যুদের কাছ থেকে ১০ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করতে হয় স্পেশাল পাস। এ কাজে সহায়ক ভূমিকা রাখে স্থানীয় এজেন্ট এবং এক শ্রেণীর জেলে।

প্রায় সকলেরই ধারণা, এ এলাকায় কেবল জেলে এবং জাহাজগুলো থেকেই নিজাম বাহিনী প্রতিদিন তিন থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করে থাকে। পারমিট না নেওয়া সকল জেলেকেই আক্রমণে পড়তে হয় নিজাম বাহিনীর। এমন দুটি নৌকা এখনো আটক আছে জাহাইজ্জার চরে। সন্দ্বীপের বাংলাবাজার এলাকার জেলে জামসেদ সওদাগর এবং দিদার সওদাগর টাকা দিতে না পারায় তাদের নৌকা এবং ১২ জেলে আটক আছে নিজাম বাহিনীর কাছে।

একই সঙ্গে আটক নকুল জলদাস ৮০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন। তবে আটক থাকার সময়ে সইতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। নকুলকে ছাড়াতে মধ্যস্থতা করেন একজন জনপ্রতিনিধি। টাকা লেনদেন হয় সন্দ্বীপ পৌরসভা কমপ্লেক্সে।

সন্দ্বীপের সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাহাইজ্জার চর, উড়িরচর শুরু থেকেই জলদস্যুদের দখলে। এখানে প্রশাসন চলে না। হাতিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী এদের নিয়ন্ত্রণ করেন। মেঘনার এ মোহনা থেকে জলদস্যুরা দৈনিক ৫ লাখ টাকা আদায় করে।’

তিনি বলেন, ‘জলদস্যুদের সবাই লিডারের বেতনভুক্ত কর্মচারী। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্ধষ সন্ত্রাসী, পাহাড়ি দুর্বৃত্ত, পলাতক বিডিআর (বিজিবি) সদস্য, উপকূলীয় বিভিন্ন বিলুপ্ত বাহিনীর সদস্যরা এখন জাহাইজ্জার চরে নিজামের সঙ্গে আছে।’

নিজাম বাহিনীর এক সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, ‘চরের চারপাশে আছে তাদের টলহল বাহিনী। এরা ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা নিয়ে জেলেবেসে টহল চালায়। চরের মধ্যে গাছের ওপর মাচা বেঁধে বানানো হয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।’

নিজামের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী বলেন, ‘চৌধুরী সাবের জন্য জাহাইজ্জার চর সবচেয়ে নিরাপদ।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বিস্তীর্ণ বন ও কাদা থাকায় প্রশাসন এবং প্রতিপক্ষ বাহিনী সহজে হামলা চালাতে পারে না। তাছাড়া কেউ এ চরে নামলে টহল বাহিনী এবং ওয়াচ টাওয়ারের সংবাদের ভিত্তিতে তা হেড কোয়ার্টারে পৌঁছে দেওয়া হয় এবং চৌধুরীসাবসহ সবাই সহজেই পালাতে পারে।’

তিনি আরো বলেন, ‘জাহাইজ্জার চরে বর্তমানে আমাদের ৫ লক্ষাধিক গরু ও মহিষ রয়েছে। সেগুলো রক্ষা করতেও আমাদের এখানে থাকতে হয়।’

নিজাম বাহিনীর হাতে বর্তমানে হাতিয়া থেকে ছিনতাই করা একটি অত্যাধুনিক স্পিডবোট, কয়েকটি ইঞ্জিননৌকা এবং কয়েকটি মোটরসাইকেল রয়েছে। যা দিয়ে সহজেই গাঢাকা দেওয়া সম্ভব।

হাতিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘এ চরে অভিযান চালানো একটি ব্যয়বহুল ব্যাপার। ২০/৫০ জন ফোর্স নিয়ে অভিযান চালিয়ে এদের ধরাও অসম্ভব। কেবলমাত্র এ ধরনের চরে একসঙ্গে সমন্বিত অভিযান চালিয়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।’

জাহাইজ্জার চরে যাওয়ার চেষ্টা বিফল, ফিরলাম দস্যুনৌকার ধাওয়া খেয়ে
সন্দ্বীপ থেকে এনজিওকর্মী হিসেবে ঢুকি বর্তমানে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ চর উড়িরচরে। কিন্তু সেখানে ঢোকার পর থেকেই জেদ চাপে জাহাইজ্জারচর যাওয়ার। অফিসে ফোন করলাম, শ্রদ্ধেয় এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনকে। তিনি কড়া নির্দেশ দিলেন, ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা বন্ধ করে নিজামের সদরদফতরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করলাম। প্রতিদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় সন্দ্বীপের জাহাজঘাটায় এসে দাঁড়াই আমি আর বাংলানিউজের ফটো সাংবাদিক উজ্জ্বল ধর। দূরে আবছা দেখা যায় জাহাইজ্জার চর। নৌকার মাঝিদের সঙ্গে কথা বলি। কেউই ১৬ কিলোমিটারের এ চ্যানেল পেরুতে চায় না। এক লাখ টাকা দিলেও নাকি কেউ যাবে না, সবার এক কথা। এ যেন ‘দেশের মধ্যে অন্য এক দেশ’। এক রাতের আঁধারে অচেনা এক মাঝি রাজি হলেন গোপনে জাহাইজ্জার চরে নিয়ে যেতে। কিন্ত কাছে ভেড়া যাবে না। হাইস্পিড ছোট নৌকা চরের পাশ দিয়ে যাবে শুধু, তাও ওই পাশে কেউ না থাকলে। যেতে হবে লুঙ্গি, গামছা পরে। উজ্জ্বলের ক্যামেরা থাকবে পাটাতনের নিচে। রাজি হলাম। পরদিন সকালে ছুটল ছোট্ট একটি মাছধরা নৌকা। আমরা উড়িরচরের বাইরের দিক দিয়ে জাহাইজ্জার চরের দিকে গিয়ে ধাওয়া খেলাম জলদস্যুদের। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধেয়ে এসে ধরতে না পেরে ফিরে গেল জলদস্যুরা। এবার আমরা ছুটলাম ঠ্যাঙ্গারচরের দিকে হাতিয়া চ্যানেলের উদ্দেশ্যে। এখান থেকে আস্তে ধীরে চর ইসলামের পাশ দিয়ে জাহাইজ্জার চরের সীমানায়। সেখানে নোঙর করা ৩ শতাধিক অভ্যন্তরীণ জাহাজ অপেক্ষা করাছে জোয়ারের জন্য। এইসব জাহাজের আড়াল নিয়ে পৌঁছালাম জাহাইজ্জার চরের কাছে। কাছ থেকে দেখা গেল জলদস্যুদের টহল নৌকা। ততক্ষণে জোয়ার হয়ে যাওয়ায় ছোট নৌকাটা পৌঁছে গেল চরের কাছে। নোনাবনে জলদস্যুদের একটি দল বসে আছে দেখতে পেয়ে উজ্জ্বল ক্যামেরা বের করল। ক্যামেরা দেখে দস্যুরা আক্রমণ করতে ভুলে গিয়ে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করল। ক্যামেরার ক্লিক শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করেই পালাতে শুরু করল আমাদের নৌকা। দূর থেকে দেখলাম ধেয়ে আসছে ডাকাতের নৌকা। আমরা ততক্ষণে নৌকার কোলের মধ্যে। অবশেষে ফিরে এলাম সন্দ্বীপে।

জলদস্যু সম্রাট এখন পৌর মেয়র, এমপিপুত্র বাহিনী প্রধান


রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বা থেকে সন্দ্বীপ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ সভাপতি মাস্টার শাজাহান মিয়া, সন্দ্বীপের বর্তমান পৌর মেয়র ও আওয়ামীলীগ নেতা এক সময় জলদস্যু বাহিনির (টিটু বাহিনি) প্রধান জাফর উল্লাহ টিটু এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা- ছবি উজ্জ্বল ধর।
  রোববার চতুর্থ কিস্তি ....

সন্দ্বীপের বর্তমান পৌর মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু এক সময় জলদস্যু বাহিনীর (টিটু বাহিনী) প্রধান ছিলেন। র‌্যাবের হাতে নিহত জলদস্যু সম্রাট বাসার মাঝি ছিল টিটুর নৌকার মাঝি। বর্তমান জলদস্যু সম্রাট নিজাম মাঝির সঙ্গেও সুসম্পর্ক আছে তার।

অভিযোগ আছে সন্দ্বীপের অনেক বন্দির মুক্তি ও মুক্তিপণ লেনদেনের মধ্যস্থতা করেন পৌরমেয়র। এছাড়া মেয়র ও তার ভাই আকতার হোসেন বাবুর বিরুদ্ধেও আছে আলমগীর পাহলবীকে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে খুন করার অভিযোগ। আকতার হোসেন বাবু বর্তমানে সন্দ্বীপের ডিস ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।

স্থানীয়দের মতে নিজাম বাহিনীর অধিকাংশ অস্ত্রের যোগান দাতা এই পৌর মেয়র। এছাড়াও তার কাছে এখনো প্রচুর অস্ত্র আছে বলেও সাধারণ মানুষের ধারণা।

স্থানীয়দের অনেকেই বাংলা নিউজকে জানান, বর্তমানে জলদস্যুতার কাজ আর তেমন প্রকাশ্যে করেন না মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু। তবে টিটুর নিয়ন্ত্রণে এখনো রয়েছে সন্দ্বীপের ৫টি মাছঘাট। গত তিন বছর তিনি বিনা টেন্ডারে এসব ঘাট চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়া সন্দ্বীপের মাছ পরিবহন, খেয়া ঘাট, বোট ও দাদন ব্যবসারও নিয়ন্ত্রক এই পৌর মেয়র।

অন্যদিকে স্থানীয় বিএনপি নেতা এবং সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশার এক ছেলে আরিফ বিল্লাহ এখন রহমতপুর এলাকার জলদস্যু বাহিনীর প্রধান।

তবে এ বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এ সব ধারণাপ্রসুত বর্ণনা। এর কোনো প্রমাণ নেই।’

তিনি বলেন, ‘এক সময় জেলে নৌকা আটক হলে সবাই আমার কাছে আসত। আমি জলদস্যুদের ফোন করে বলতাম- ভাই গরিব মানুষ। এদের ছেড়ে দাও। এতে কাজ হতো। তারা ছেড়ে দিত।’

টিটু বলেন, ‘এরপর শতশত মানুষ আমার কাছে আসতে থাকে এবং বাইরে প্রচার হতে থাকে আমিও জলদস্যু।’

এ দিকে সন্দ্বীপ পৌরসভা এলাকাকে জলদস্যু ও সন্ত্রাসীদের আস্তানা হিসেবে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি তার আত্মীয় ও একজন জলদস্যু সম্রাটকে (টিটু বাহিনীর প্রধান জাফর উল্লাহ টিটু) সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে পৌর মেয়র নির্বাচিত করেছেন।’

তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদরা নিজেরা মাফিয়াচক্রে জড়িয়ে গেছি। বিবেক সোজা করে দাঁড়াতে পারছি না। প্রশাসনকে কিছু বলতে পারছি না। ওসি সাহেব, এসপি সাহেব, ডিসি সাহেব কথা বললেই বিব্রত বোধ করেন।’

এ বিষয়ে মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু বলেন, ‘ওনার (এমপি কামাল পাশা) সঙ্গে তো আমার সব সময় দেখা হয়। কথা হয়। তিনি প্রমাণ সহকারে বলুক।’

সন্দ্বীপের উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাজাহান মিয়া এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমপি সাহেবের চারদলীয় শাসন আমলে সন্দ্বীপে কোনো আওয়ামী লীগের মানুষ থাকতে পারেনি। এখন তারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করছে। এখানে কোনো সন্ত্রাসী নাই।’

এছাড়াও সন্দ্বীপে বর্তমানে অবস্থান করছেন জাসু ওরফে জাইস্যা নামের এক কুখ্যাত জলদস্যু। যে এক সময়ে নাসির কেরানীর কমান্ডার হিসেবে কাজ করত।

তবে এখন সন্দ্বীপের বাহিনীগুলোকে খেয়ে ফেলেছে নিজামবাহিনী। সন্দ্বীপের মাকসুদ বাহিনী মীর সরাইয়ের ডোম খাল এলাকা থেকে বিপুল অস্ত্র ও লোকবল জোগাড় করে জাহাইজ্জার চর দখলে আসে। এ সময় নিজাম বাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে মাকসুদসহ ৪৬ জনকে খুন করে ও অস্ত্র লুট করে।

তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের দাবি এখানে ঘটে যাওয়া ৯০ শতাংশ সংবাদই থাকে গণমাধ্যমের আড়ালে। নিজের জীবন বাঁচাতেই গণমাধ্যমকর্মীরা হজম করে ফেলেন এসব সংবাদ। আবার কখনো কখনো গহীন জঙ্গল ও জনমানবহীন সমুদ্রের বুকে ঘটে যাওয়া ঘটনার সংবাদ থেকে যায় অজানাই।

সন্দ্বীপের বাংলাবাজার এলাকার ধূপের খাল এখন দখলে আছে কুখ্যাত দিদার বাহিনী ও আকবর বাহিনীর। চট্টগ্রাম থেকে এ এলাকায় অবাধে ড্রাগ পরিবহন হয়।

মাইটভাঙ্গা এলাকার জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় চেয়ারম্যান মিজান ও বাউরিয়া এলাকা নিয়ন্ত্রণ আছে বাইস্যা রহিমের।

রহমতপুরে আছে বাইন্যে টিটু, মাইন উদ্দিন প্রকাশ মাইন্যে, ফোকরান উদ্দিন রিজভী, সাবেক স্বারাষ্ট্রমন্ত্রী খ্যাত রহমত পুরের বর্তমান চেয়্যারম্যান মামুন, বর্তমান সংসদ সদস্য কামাল পাশার মেজ ছেলে আরিফ বিল্লাহ।

সারিকাতের সোহরাব বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে সন্দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল।

এসব বাহিনী কেবল সমুদ্র বা উপকূলে তাদের তাণ্ডব চালিয়েই ক্ষান্ত হয় না। প্রবাসী অধ্যুষিত এ দ্বীপ উপজেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবহনসহ সকল কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এদের অত্যাচারে সন্দ্বীপের কোনো মানুষই এখন আর তাদের সন্তান-সম্পত্তি সন্দ্বীপে রাখতে চান না। যেতেও চান না প্রিয় মাতৃভূমিতে।

এমনকি এদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাদের অভিমত, মুখ খুললেই রাতের আঁধার, এমনকি দিনের আলোতেও অত্যাচার, খুন, গুম, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটায় দস্যুরা।

স্থানীয়রা জানায়, সন্ত্রাসী ও জলদস্যুরা সন্দ্বীপ এবং এর উপকূলীয় এলাকায় অপরাধের ঘটনা ঘটিয়ে চলে যায় ১৮ কিলোমিটার দূরের উড়িরচরে। এখানকার কিছু অঞ্চল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের অংশ হওয়ায় নির্বিঘ্নে গা ঢাকা দেওয়া সহজ হয়। তাছাড়া উড়িরচরের খোকা বাহিনীর প্রধান খোকাসহ প্রায় সবাই সন্দ্বীপের কালাপানিয়া ইউনিয়ন ও ভেঙে যাওয়া আমিরাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়ায় এখানে আশ্রয় নেওয়াও সহজ।

মুক্তি চায় সন্দ্বীপবাসী
দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। এর প্রায় দুই লাখই প্রবাসী। যার সিংহভাগই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। নদী ও সাগরের ভাঙন-প্রবন এ দ্বীপের অধিকাংশই এখন সাগরের জলে হারিয়ে গেছে। তবু অদম্য মানুষগুলো সব হারিয়েও বাঁচার আশা ছাড়েনি। তারা পাড়ি জমিয়েছে চট্টগ্রামের হালিশহর, ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে। এসব মানুষ শিকড়ের টানে ফিরতে চায় প্রিয় মাতৃভূমিতে। কিন্তু সন্ত্রাস আর জলদস্যুর উৎপাতে তারা অসহায়।

সন্দ্বীপের সংসদ সদস্যের ভাষ্যমতে,  দেশে প্রবাসীদের কাছ থেকে যে রেমিট্যান্স আসে তার ১১ ভাগই আসে সন্দ্বীপে। অথচ এখানকার মানুষ সবদিক থেকে অবহেলিত।

কয়েকজন স্কুলশিক্ষক জানালেন, একদিকে প্রকৃতি যেমন গ্রাস করছে সন্দ্বীপকে, অন্যদিকে জলদস্যুতা ও সন্ত্রাস ম্রিয়মান করে দিচ্ছে সন্দ্বীপবাসীর সাফল্যের ইতিহাস।

বাংলাবাজার এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে সাগরে বসতবাড়ি হারানো দেড় হাজার জেলে পরিবার। গভীর সাগরের বুকে মাছ ধরাই তাদের একমাত্র পেশা। কিন্তু গত দেড় মাস ধরে তারা সাগরে যেতে পারছে না জলদস্যুর ভয়ে। এমনকি সন্দ্বীপে প্রবেশের ঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও এসব সন্ত্রাসী জলদস্যুর হাতে। এখন নতুন ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে মাদকের ব্যবহার। ধুপেরখাল ঘাট, সোয়াখালি ঘাট, গুপ্তচরা ঘাট দিয়ে অবাধে আসছে হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ ইত্যাদি।

ফখর ইসলাম, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দীন, সুফিয়ান, মহসিন, নাজিম উদ্দিন আলম, আজিজ সওদাগরদের মতো অনেকেই জানালেন, জেলেদের মধ্যেই আছে জলদস্যুদের এজেন্ট। এছাড়া সচ্ছল ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করেন জলদস্যুদের এজেন্ট হিসেবে।

তারা বলেন, ‘কোস্টগার্ডকে এসব বললে কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় কোস্টগার্ডের সামনেই নৌকা ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন কোস্টগার্ড উল্টো জেলে নৌকার লাইসেন্স পরীক্ষার নামে সময়ক্ষেপণ করে দস্যুদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।’

স্থানীয় সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা ও সন্দ্বীপ উপজেলা চেয়ারম্যান মাস্টার শাজাহানের অভিযোগ, ‘শুনেছি প্রশাসন ও কোস্টগার্ড জলদস্যুদের সহায়তা করে।’

এ বিষয়ে কোস্টগার্ডের চট্টগ্রাম অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রধান ক্যাপটেন জাবেদ ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ অঞ্চলে কে জলদস্যু আর কে সাধারণ জেলে তা বোঝা খুব কঠিন। তাছাড়া সব সময় জেলেরাও সঠিক তথ্য দেয় না। জলদস্যুদের সনাক্ত করতেই লাইসেন্স পরীক্ষা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘র‌্যাবকে যে ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে তাতে তারা যেভাবে অভিযান চালাতে পারে, আমরা সেভাবে পারি না। তবে সমন্বিত অভিযানের মাধ্যমে জলদস্যু দমনের চেষ্টা চলছে।’

তিনি বলেন, ‘কোস্টগার্ড অনেক সময় সোর্স ব্যবহার করে। সোর্স হয়ত জলদস্যু হতে পারে। কিন্তু তাদের নিয়ে যখন সবার সামনে যাওয়া হয়, তখন তো কেউ বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলেন না।’

এ বিষয়ে সকলের সাহযোগিতা চান তিনি।

অত্যাচারের কাহিনী প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে পারেননি সন্দ্বীপবাসী
নিজেদের এ দুঃসহ জীবন যুদ্ধ ও অত্যাচারিত জীবনের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানাতে পারেননি সন্দ্বীপবাসী। ২২ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সন্দ্বীপ এলে বিষয়টি তুলে ধরার কথা হয় শতধা বিভক্ত এ উপজেলা আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে। কিন্তু দলের স্থানীয় প্রভাবশালীরা এ বিষয়ে বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর শোনা হয়নি এ দ্বীপবাসীর চাপা কান্না।

সন্দ্বীপ উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মাস্টার শাজাহান মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে বলা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘সব বিষয় কি প্রধানমন্ত্রীকে বলা যায়! তাছাড়া এখানে তো প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। তিনি বললেই তো সব কিছুর সমাধান হয় না।’

উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, ‘জলদস্যুদের মূল আস্তানা জাহাইজ্জার চর ও উড়িরচর। এখানে বহিরাগতরাই দস্যুতা করে।’

চরে বাহিনীর দরকার আছে : হাতিয়া পৌর মেয়র


রহমান মাসুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ছবি : মেয়র ইউসুফ, বর্তমান এমপি ফজলুল আজিম ও সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলী
  সোমবার পঞ্চম কিস্তি...

জলদস্যুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হাতিয়ার তিন লাখ চরবাসী। এখানকার ভোটারের সংখ্যাও কম নয়। ৩৮ হাজার ৮০০ জন ভোট দিয়েছেন ২০০৮ সালের সংসদ ও গত উপজেলা নির্বাচনে। এই ভূমিহীন ভোটারদের নিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীরা করেন রাজনীতি। আর ভোটারদের নিজের হাতে রাখতে অন্যান্য অনেক কৌশলে সঙ্গে লালন করেন দস্যু বাহিনী।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা (বহিষ্কৃত) মোহাম্মদ আলী বর্তমানে দস্যুসম্রাট নিজাম চৌধুরীকে (নিজাম ডাকাত) লালন করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করছেন হাতিয়া পৌরসভার মেয়র একেএম ইউসুফ আলি। মেয়র মনে করেন, চরের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে।

নিজাম ডাকাত বাংলানিউজকে বলেন, তিনি কোনো রাজনৈতিক দলে বিশ্বাস করেন না। তবে মোহাম্মদ আলী ও মেয়র ইউসুফ আলী আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাই তিনিও আওয়ামী লীগ করেন।

অভিযোগ আছে, হাতিয়া পৌরসভার জন্য স্থানীয় সরকারের দেওয়া ডাম্প ট্রাকটিও মেয়র ইউসুফ দিয়ে দিয়েছেন নিজামকে। চরের ধান সংগ্রহের জন্য তিনি এটি ব্যবহার করেন।

ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘চরে ভূমি বণ্টন এবং তা ব্যবহারের জন্য আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজন। এজন্য বাহিনী দরকার। বিশেষ করে, সাধারণ প্রশাসন যেখানে অনুপস্থিত সেখানে বাহিনী না থাকলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।’

তিনি বলেন, ‘চরে একজনের ওপর দাঁড়িয়ে আরেকজন পার হয়। এগুলো হয়তো আপনারা যারা বাইরের মানুষ, তাদের কাছে রোমহর্ষক। কিন্তু আমাদের মতো স্থানীয়দের কাছে তা খুবই স্বাভাবিক।’

ইউসুফ আলি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতাই চরের এসব বিকল্প বাহিনীর উত্থান এবং বিস্তারের মূল কারণ। এখানকার ইতিহাস বড়ই করুণ এবং হৃদয়স্পর্শী। হাজার হাজার ভূমিহীন নদীর বুকে সব হারিয়ে সাগর ও জেগে ওঠা ওইসব চরে গিয়ে ভিড় করে। এর আগেই অবশ্য এক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী (বাহিনী) ওই চরগুলোয় তাদের ঘাঁটি গাঁড়ে। প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে সম্পৃক্ত হয়।’

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনিক কারচুপির মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক রেষারেষিতে অনেক দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়েছে, মামলা মোকদ্দমা হয়েছে। যারা আসামি তাদের বেশির ভাগই দোষী নয়, সাধারণ ভূমিহীন।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চরে রাজনৈতিক কারণে একটা পক্ষ গোপনে নানা সহিংস ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। একদিন সকালে ক্যারিংচরের মুজিব বাজারে আমরা একটি সভা করি। এরপর বিকালেই বাসার মাঝির মেয়ের জামাই নবী মাঝিকে (নবী ডাকাত) ধরে নিয়ে যাওয়া হয় র‌্যাব পরিচয়ে। তাকে আজও পাওয়া যায়নি। আমি ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী নবী মাঝির ব্যাপারে র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করি। র‌্যাব এ ঘটনাকে অস্বীকার করে।’

এভাবে চরে প্রতিদিনই অসংখ্য গুপ্ত হত্যা চলছে বলেও জানান তিনি। আর এসবের জন্য সরাসরি দায়ি করেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমকে।

ইউসুফ আলী বলেন, ‘বাসার মাঝি শেষ জীবনে এসে সংযত হয়েছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য সামাজিক কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি রুই মাছের ডিম এনে পুঁঠি মাছদের খাওয়াতেন (বড়লোকের টাকা এনে গরিবকে খাওয়াতেন)।’

মেয়র ইউসুফ আরো জানান, বাসার মাঝির মেয়ের জামাই নবী মাঝি ১০/১২টি ব্রিক ফিল্ডে চরের সাধারণ মানুষদের কাজ দিতেন। চেয়ারম্যান ঘাটে তার মাছের ব্যবসা ছিল। সাগরে তার বড়বড় জাল ছিল। সেখান থেকে তার প্রতিদিন লাখলাখ টাকা আয় হতো। (এ অঞ্চলের মাছের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেন নবী মাঝি। হাজার হাজার জেলে তার কাছে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হতেন। নবীর মাধ্যমে জেলেরা নদী ও সাগরে মাছ ধরার পারমিট সংগ্রহ করতো।)

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি চরের ১০টি কেন্দ্রে পুনঃভোট হওয়া প্রয়োজন। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। আজিম সাহেব এসব ঠেকাতে চরে গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। আমি মনে করি, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে চরে বর্তমান এমপি, নিজাম বাহিনীর বিরুদ্ধে গোপনে আর একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ দাঁড় করিয়েছে। তারাই গুপ্ত হত্যা চালাচ্ছে।’

তিনি জানান, চরের অবস্থা বর্তমানে খুবই উত্তপ্ত। সামনে বর্ষা মৌসুম আসছে। সারাদেশ থেকে এ এলাকায় লাখ লাখ ইলিশ ধরার নৌকা আসবে। প্রতিদিন শতশত কোটি টাকার ইলিশ উঠবে। এছাড়া চরের লাখলাখ একর জমিও বর্ষা মৌসুমে চাষ শুরু হবে। এসব সামনে নিয়েই চর ক্রমশঃ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের এমপি মনে-প্রাণে চান না চর থেকে দস্যুতা দূর হোক। তিনি তা চাইলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গোপনে বা একান্ত বৈঠকের মাধ্যমে সন্ত্রাস এবং দস্যুতা দূর করার চেষ্টা চালাতেন। তিনি তা না করে সংসদে এ নিয়ে কথার বান ছোটান। এতে সরকার বিব্রত হয়। এমপির কথামতো চরে অভিযান চালালে তার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়। এজন্য, সরকারও ইচ্ছা থাকা সত্বেও কিছু করতে পারছেনা।’

এসপিকে সরিয়ে নিলে অবস্থার উন্নতি হতো- এমপি আজিম
এদিকে হাতিয়ার চলমান পরিস্থিতির জন্য সাবেক সাংসদ মোহাম্মদ আলী, পৌর মেয়র ইউসুফ আলী এবং নোয়াখালীর পুলিশ সুপারকে দায়ি করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান নোয়াখালির পুলিশ সুপারকে প্রশাসন থেকে সরিয়ে নিলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’

একই সঙ্গে এমপি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগও অস্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমান পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারীকে প্রশাসন থেকে সরিয়ে নিলে জলদস্যুতা, বনদস্যুতা এবং ভূমিদস্যুতা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো।’

তিনি বলেন, ‘এসপিই সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সে এমন একটা অবস্থান তৈরি করেছে যে এতো বছর পরও সে বদলি হয়না। প্রতি মৌসুমে সে কোটি কোটি টাকা ভাগ নেয়। মোহাম্মদ আলী ও চাটখিলের জাহাঙ্গীরের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তা) মাধ্যমে সে এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করে।’

ফজলুল আজিম বলেন, ‘কিছুদিন আগেও ক্যারিংচরে ৩৮জন জলদস্যুকে আটক করে ভূমিহীনরা। পরে তাদের হাতিয়া থানা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের পর এসপির নির্দেশে পুলিশ তাদের ছেড়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘ইলিশ মৌসুমে এ এলাকায় কয়েক লাখ জেলে নৌকা আসে। এসব নৌকা পিছু মাছ ধরার জন্য জলদস্যুরা ছোট নৌকা ১০ হাজার ২০০ টাকা এবং বড় নৌকা থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে। এ হিসেবে প্রতি ইলিশ মৌসুমেই এ অঞ্চল থেকে জলদস্যুরা আদায় করে শতশত কোটি টাকা। এছাড়া চেউয়া মৌসুমে নৌকাপ্রতি ২০ হাজার টাকা ও চিংড়ি মৌসুমে ও ১০ হাজার করে টাকা আদায় করে ডাকাতরা। তবে এ দুই মৌসুমে জেলে নৌকা কম আসে।’

স্থানীয় এ সংসদ সদস্য বলেন, ‘বর্তমান এসপি এ টাকার ভাগ পায়। এ টাকা ঢাকার অনেক বড় জায়গায় যায়। আর তাই প্রশ্ন ওঠে- একজন পুলিশ সুপার কি করে এতো বছর এক জায়গায় থাকে! ৫বার বদলি আদেশের পরও তিনি থেকে গেলেন কী করে?’

ফজলুল আজিম বলেন, ‘আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আইজির কাছে বিষয়টা কয়েকবার বলেছি। কোন কাজই হয়না। এরপর জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও কয়েকবার বলেছি। কাজ হয়না। যেখানে সংসদে বললেও কাজ হয়না, সেখানে বলে কী লাভ?’

তিনি বলেন, ‘মুন্সীয়া অনেক বড় ডাকাত ছিল। বাসার মাঝিও বড় ডাকাত ছিল। এরা নিজেদের যুদ্ধ ও র‌্যাবের হাতে মারা গেছে। এটা মানুষের জন্য রহমত। এটা ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। এছাড়া যোগাযোগ অবস্থার উন্নতি ঘটলে চরের মানুষ এসব থেকে মুক্তি পেত।’

তিনি বলেন, ‘যারা মুল ধারার আওয়ামী রাজনীতি করে তারা কিন্তু ভূমিহীনের পক্ষ্যে জলদস্যুদের বিপক্ষে। তবে হাতিয়ায় একজন গড ফাদার আছেন, মোহাম্মদ আলী। তিনি হাতিয়ায় আসলে শতশত জলদস্যু নিয়ে আসেন। বাসার মাঝির সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। বাসার মাঝি চরে মোহাম্মদ আলীকে ১০০ একরের একটি খামার করে দিয়েছিল। এখন সে খামার নিজাম দেখাশোনা করে। মোহাম্মদ আলীর মিসেস সেখান থেকে ফসল বুঝে আনে। তিনি চরে গিয়ে নির্ভয়ে ডাকাতদের সঙ্গে থাকেনও।’

আজিম বলেন, ‘প্রশাসন যদি শক্ত হতো, পুলিশ এবং কোস্টগার্ড যদি শক্ত অবস্থানে যেতো তাহলে মানুষ নির্ভয় হতে পারত। কিন্তু এখানে পুলিশ প্রশাসন বলে কোনো প্রশাসন নেই। কোনো অফিসার কোনো দস্যুকে আটক করলে তাকে শিবিরকর্মীর অপবাদ দিয়ে ক্লোজ করা হয়, এটাই এখানকার চিত্র। মোহাম্মদ আলীর এক ভাই পুলিশের ডিআইজি (মাহাবুব)। তারে দিয়েই মোহাম্মদ আলি সব কব্জা করে রাখছে।’

এমপি সাহেব সত্য কথা বলে না- এসপি হারুন

তবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলুল আজিমের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নোয়াখালীর পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ হাজারী।

বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব রাজনীতির খাতিরে কখনো সত্য কথা বলেন না।’

তিনি বলেন, ‘এমপি সাহেব রাজনীতি করেন। নানান কথা বলেন। তার অন্তরে এক আর মুখে আর এক।’

পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘তার অভিযোগের বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’

তিনি বলেন, ‘ফজলুল আজিম সাহেবের অভিযোগ সম্পর্কে আমি শুধু বলব, তিনি সংসদে দাঁড়িয়েও আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন। আমার বিষয়ে সংসদীয় তদন্ত কমিটি হয়েছে। ডিজিএফআই, এনএসআই, এসবি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে।’

এসপি হারুন বলেন, ‘এসব তদন্তে যদি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা মিলতো তাহলে নিশ্চয়ই সরকার আমাকে প্রত্যাহার করে নিত।’

বাংলানিউজের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চরের অবস্থা স্থিতি পর্যায়ে আছে। তবে কখণ পরিস্থিতি খারাপ হবে এটা বলা যায়না। যে কোনও সময় অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। এটাই চরের আইনশৃঙ্খলার ধর্ম।’

হাতিয়ার জলদস্যুদের ইতিবৃত্ত
১৯৯১-র প্রলয়ংকারী জলোচ্ছাসের পরপরই নদী ভাঙ্গন কবলিত হাতিয়ার চারপাশে মেঘনা এবং বঙ্গোপসাগরের বুকে পলি জমে নতুন নতুন চর জেগে ওঠে। নব্বই দশকের শেষের দিকে আওয়ামীলীগ সরকার নতুন জেগে উঠা এসব চরে ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু করে।

১৯৯৮ সালের গোড়ার দিকে বাশার মাঝি, নব্বা চোরা, শফি বাথাইন্না, সোলেমান কমান্ডারসহ প্রায় ১ ডজন জলদস্যুর উত্থান ঘটে এসব চরে। প্রশাসনের নজরের আড়ালে থেকে এসব জলদস্যু মেঘনার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করতে থাকে। তারা ম্যানগ্রোভ বনায়ন প্রকল্পের গাছ নিধন করে জেগে ওঠা চরগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ভূমিহীনদের কাছে জমি বিক্রী শুরু করে। সেময় বনদস্যু-ভূমিহীন ও দস্যু-দস্যু সংঘর্ষে বহু ভূমিহীন ও দস্যু নিহত হয়।

২০০৩ সালের ৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর দস্যু নির্মূল অভিযানে এসব চরে প্রায় অর্ধশত দস্যু নিহত হয়। সেসময় বেঁচে যায় বাশার মাঝি। পরে বাশার মাঝি দলছুট হয়ে পড়া অন্যান্য দস্যু বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করে গড়ে তোলে এক বিশাল বাহিনী- চরে শুরু হয় তার একচ্ছত্র আধিপত্য। এ বাহিনীর নাম হয় বাশার বাহিনী।

সে থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় চরাঞ্চলে বলা যায় রাম রাজত্ব কায়েম করে বাশার বাহিনী।

বাশার মাঝির অধীনস্থ কমান্ডারদের মধ্যে আলোচিত ছিল- মিয়া শিকদার, মালেক ফরাজি, মতিন কশাই, গরু করিম, বাহার কেরানি (বর্তমানে নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড), হাত কাটা হারুন, নিজাম ডাকাত, নাছির কেরানীসহ প্রায় ৫ শতাধিক জলদস্যু। বেপরোয়া এসব দস্যুনেতা হাতিয়ার বয়ারচর, নলেরচর, ক্যারিংচর, চরবাশার, জাহাইজ্জার চর, ঢালচর, উড়িরচর, ঠাঙ্গারচর, চর ইসলামসহ উপকূলীয় মেঘনায় ডাকাতি, হত্যা, নারী ধর্ষণ, বনউচ্ছেদসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত।

অপরদিকে, হাতিয়া উপজেলা এলাকায় বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা জাহাজমারার কালাম চরে আস্তানা তৈরি করে মেঘনার অপর জলদস্যু কালা বাদশা। ২০০৯ সালের ১৬ অক্টোবর শীর্ষ সন্ত্রাসী কালা বাদশা পুলিশের সঙ্গে বন্ধুকযুদ্ধে নিহত হয়। কালা বাদশার তৈরি করা আস্তানা পরবর্থীতে দখল করে নেয় মুন্সিয়া ডাকাত। তার বাহিনীর নাম হয় মুন্সিয়াবাহিনি। মুন্সিয়া ডাকাত এখান থেকে পুরো বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করত। সেসময় মুন্সিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে চর চ্যাঙ্গার অপর জলদস্যু ইব্রাহীম ডাকাত।

এরই সূত্র ধরে ২০১০ সালের ১৯ মে মুন্সিয়া ডাকাত ও ইব্রাহীম ডাকাতের মধ্যে বন্দুক যুদ্ধে ইব্রাহীম ডাকাতসহ তার অধীনস্থ কমান্ডার সুমন ও মনপুরার পিচ্চি খোকাসহ উভয় পক্ষের ৩০ সদস্য নিহত হয়।

২০১০ সালের ৬ জুন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় বনদস্যু বাশার মাঝি। বাশার মাঝির মদদে ছিলেন হাতিয়ার সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলি। বাশার মাঝির মারা যাওয়ার পর দায়িত্বগ্রহণ করে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নাসির কেরানী। তখন বাশার বাহিনীরই নাম হয় নাসির বাহিনী। এলাকার জনশ্রুতি মতে- এ পর্যায়ে নাসির বাহিনীর কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন মোহাম্মদ আলী। কিন্তু ক্রস ফায়ার থেকে বাশার মাঝিকে বাঁচাতে না পারার ব্যর্থতার কারণ দেখিয়ে মোহাম্মদ আলীকে চাঁদা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে নাসির। এ নিয়ে মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে বিরোধ বাঁধে নাসির কেরানীর।

এদিকে, মুন্সিয়া চোরা নিজ দলীয় কোন্দলে নিহত হওয়ার পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তার দল। বিলুপ্ত প্রায় মুন্সিয়া বাহিনীর সদস্যদেরকে একত্রিত করে বাশার মাঝির থার্ড ইন কমান্ড সুর্বনচরের নিজাম ডাকাত গঠন করে নিজাম বাহিনী।

একপর্যায়ে নাসির কেরানী র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছে এমন খবরের পর ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় নাসির গ্রুপ। ফলে নাসির তথা বাশারের আস্তানা দখল করে নেয় নিজাম ডাকাত। বর্তমানে জাহাইজ্জার চরে আস্তানা নিজাম ডাকাতের। বাশার মাঝির অনেক বিশ্বস্ত কর্মী এখন নিজাম বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছে। নিজামের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করছেন বাহার কেরানী।

হাতিয়ার মূল ভূখণ্ডের পশ্চিমভাগে তমিরুদ্দী এলাকায় দস্যুতা করছে হক বাহিনি। তবে কোস্টগার্ড জানায়, তার কর্মকাণ্ড সীমিত রয়েছে জাঙ্গলার চর, ঢালচর ও ভোলার মনপুরা এলাকায়।

সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য গত কয়েকদিন যাবত সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর মোবাইল ফোনে বারবার কল করেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি কল রিসিভ করছেন না। এমনকি তার বক্তব্য চেয়ে এসএমএস দিলেও কোনও জবাব দেননি মোহাম্মদ আলী। এ কারণে তার মতামত দেওয়া গেল না।
  
আজ এর ষষ্ঠ কিস্তি ...

হাতিয়ার সেন্টার বাজারের আবুল হাসেমের দুই ছেলে শাহিন এবং হাসান নৌকা নিয়ে ধান আনতে গিয়েছিল ক্যারিংচরের বাথানখালি বাজারে। নিজেদের নয়, ভূমিহীন এই দুই সহোদর আনতে গিয়েছিল এক ব্যাপারীর ধান। নৌকাটি নদী পেরিয়ে খালে ঢোকার মুখেই বাহার কেরানীর নেতৃত্বে জলদস্যুদের একটি দল তাদের আটক করে। এরপর ব্যাপারীর কাছে মুক্তিপণ দাবি করে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যাপারী বিপুল অংকের মুক্তিপণ দিতে রাজি না হওয়ায় হাসান ও শাহিনকে হত্যা করেন নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানী। তাদের পেট কেটে মেঘনায় ভাসিয়ে দেন। এর আগে ব্যাপারীর কাছে ফোন করে কথা বলান ওই দুই সহোদরকে দিয়ে। নিজেদের কণ্ঠেই তারা মৃত্যুর দুঃসংবাদ পৌঁছে দেন স্বজনের কাছে। এখনো তাদের মা নলের চরে পাগলের মতো খুঁজে বেড়ান দুই সন্তানের মৃতদেহ। বাড়িতে অপেক্ষায় মৃত শাহিনের স্ত্রী এবং একমাত্র শিশু সন্তান।

হাতিয়ার চরাঞ্চলে এমন রোমহর্ষক ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে বলে জানালেন নিহত হাসান ও শাহিনের মামা সাবেক ইউপি মেম্বার নুর হোসেন। দুইদিন ধরে চরে খুজেঁও পাওয়া গেল না হত্যার শিকার দুই সহদরের পাগলপ্রায় গর্ভধারীনীকে। জোগাড় হলো না তাদের কোনো ছবিও।

শাহিন ও হাসানের মামা নুর হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনার পর থেকে শাহিন এবং হাসানের বাবা-মা পাগলের মতো খুঁজে ফিরছেন সন্তানদের। অন্যদিকে শাহিনের স্ত্রী বাপের বাড়িতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছেন শিশু সন্তানকে নিয়ে। তারা বিশ্বাস করতে চান না, প্রিয় স্বজন চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ফিরবেন না কোনো দিনই।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাতিয়া পৌর চেয়ারম্যান একেএম ইউসুফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এমন ঘটনা চরে অহরহ ঘটে। এটা এখানকার জন্য খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনারা যারা বাইরে থাকেন তাদের জন্য তা রোমহর্ষক হতে পারে।’

চরের আড়াই লাখ ভূমিহীন জিম্মি হয়ে আছে এ জলদস্যুদের হাতে। বর্তমানে এর নেতৃত্বে আছে নিজাম বাহিনী। কিন্তু ভয়ে কেউই মুখ খোলেন না এ বিষয়ে।

কেবল হাতিয়াতেই বা কেন! খোকা বাহিনীর হাতে নিহত উড়িরচরের জাহাঙ্গীর মেম্বার তিন বছর আগে খুন হন জনসম্মুখেই। শালিসের কথা বলে জাহাঙ্গীরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ফেরার পথে অন্য দুই মেম্বার ও গ্রামবাসীর সামনেই খোকা, সুফিয়ান, শাহিন, মহব্বত, হাফেজ, দুলাল মেম্বার, কাশেমসহ ২০/২২ জনের একটি গ্রুপ জবাই করে তাকে। এ হত্যাকাণ্ডের পর বাড়ি থেকেও উচ্ছেদ করা হয়েছে জাহাঙ্গীরের পরিবারকে। বর্তমানে এ পরিবারের আশ্রয়স্থল উড়িরচরের শেখ হাসিনা আশ্রয় কেন্দ্রে।

মৃত জাহাঙ্গীরের বড় ছেলে সাইফুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের বাড়িটি ‘ভুতের বাড়ি’ হিসেবে এখন উড়িরচরে পরিচিত। বাড়িতে গেলে আমাকেও খুন করা হবে বলে হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসী খোকা।’

তিনি বলেন, ‘যেদিন মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে, সেদিন সন্দ্বীপের ওসি আমাকে থানায় যেতে ফোন করেন। অন্যদিকে খোকা ও তার ভাই আমাকে ঠেকানোর জন্য অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেন। এরপর আমার মা আমাকে হারানোর ভয়ে আর থানায় যেতে দেননি।’

তিনি বলেন, ‘এ সুযোগে খোকার লোকজন ওসিকে দিয়ে চার্জশিট থেকে মূল আসামিদের বাদ দিয়ে মামলার সাক্ষীদের আসামি করে চার্জশিট দেয়।’

সাইফুল জানান, এ হত্যাকাণ্ডের পর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি জিডি করার পর পুলিশ দুলাল মেম্বার, লিয়াকত, জাসু ও মহব্বতকে আটক করে। পরে তাদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ হত্যা মামলা দায়ের করে। কিন্তু চার্জশিটের দিন খোকা খুনের হুমকি দিলে মৃত জাহাঙ্গীরের ছেলে সাইফুল থানায় যাওয়া থেকে বিরত থাকে। এ অবস্থায় মামলার মূল আসামিদের বাদ দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী বাবুল সেক্রেটারি, হান্নান ও বাহার মেম্বারকে আসামি করে পুলিশ চার্জশিট দেয় (এরা সবাই ওই সালিশ শেষে জাহাঙ্গীর মেম্বারের সঙ্গে ফিরছিল এবং সবাই খোকা বাহিনীর হামলায় গুরুতর আহত হন)। বর্তমানে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন।

২০১১ সালের হাতিয়ায় জলদস্যুদের রক্তাক্ত ইতিহাস
কেবল ওপরের দুটি ঘটনাই নয়, ২০১১ সালের ১৮ জানুয়ারি চর বাশারে দস্যুদের গুলিতে নিহত হন ভূমিহীন গিয়াস উদ্দিন (৪২), রায়হান (০৯), মাইন উদ্দিন (৮৫), লিটন (৩৫), আব্দুল জলিল ওরফে আর্মি (৪২) ও ভুট্টুসহ (৩৮) ১০ জন নিহত হন। তবে নিহতদের লাশ পেট কেটে ফেলে দেওয়া হয় মেঘনায়। লাশের সন্ধান পায়নি তাদের স্বজনরা।

১৬ মার্চ হাতিয়ার মেঘনা নদীতে জলদস্যুর গুলিতে নিহত হন রুবেল (২৩) নামের এক জেলে।

২৪ মার্চ মুন্সিয়া বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে লাঞ্ছিত হন সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম। ২১ মার্চ জাতীয় সংসদে মেঘনার জলদস্যুদের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন। এর তিন দিন পর ২৪ মার্চ বড় ছেলে ফ‍ারহান আজিমসহ নির্বাচনী এলাকা হাতিয়ায় আসার পথে চেয়ারম্যান ঘাটে পুলিশের সামনেই মুন্সিয়া বাহিনী সশস্ত্র প্রতিরোধে গড়ে তোলে। এ সময় দস্যুরা আজিমের ওপর ইটপাটকেল ও কাদা মাটি নিক্ষেপ করে তাকে লাঞ্ছিত করে। তিনি ঢাকা ফিরে যেতে বাধ্য হন। এর আগের বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ইদুল ফিতর উপলক্ষে হাতিয়ায় ফেরার পথেও এই দস্যুবাহিনীর হাতে তিনি লাঞ্ছিত হন।

১০ মে মঙ্গলবার মেঘনার জলদস্যু নিজাম ডাকাত ও নাছির গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে স্থানীয় বাসিন্দা জামাল বাতাইন্না (৫৫) নিহত ও সিরাজ কমান্ডার (৩৮), আজহার কমান্ডার (৩৫) এবং ফরিক কমান্ডার (২৭) নামে চার দস্যু গুলিবিদ্ধ হয়।

২ জুলাই বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেঘনায় জলদস্যু মুন্সিয়া বাহিনী ও নিজাম ডাকাত গ্রুপের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে ৮ দস্যু নিহত হয়।

৩ জুলাই রোববার সকালে জলদস্যুরা মেঘনার বিভিন্ন স্থানে তাণ্ডব চালিয়ে ৩০ মাছ ধরা ট্রলারসহ ৩ শতাধিক জেলেকে অপহরণ করে। পরদিন সোমবার একই দস্যুরা আবারও তাণ্ডব চালিয়ে ৫০ মাঝি- মাল্লাকে অপহরণ করে। পরে বিভিন্ন সময়ে তাদের কয়েকজনকে লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

৫ জুলাই রোববার দিবাগত রাত ২টায় মেঘনার অর্ধশতাধিক মামলার আসামি কুখ্যাত জলদস্যু মুন্সিয়া বাহিনীর প্রধান মুন্সিয়া চোরা তার সদস্যদের আন্তঃকোন্দলে নিহত হন। এতে তার বাহিনীর অত্যাচার থেকে কিছুটা শান্তি পায় দক্ষিণাঞ্চলের জেলেরা।

১৮ জুলাই মেঘনা নদী থেকে জলদস্যুদের হাতে গলাকাটা এক অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

৩ আগস্ট বুধবার দুপুরে একই দস্যুরা চাঁদার দাবিতে বয়ারচর মাইন উদ্দিন বাজার এলাকার ভূমিহীন সাদ্দাম হোসেনকে অপহরণ করে হাত কেটে দেয়। একই দিন নলেরচর ভূমিহীন বাজার এলাকার মিরাজ উদ্দিন আবু জাফর, আব্দুল মতিনসহ কয়েকজন ভূমিহীনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে দস্যুরা সাদ্দাম ও সেলিমের হাত কেটে দেয়।

১৫ আগস্ট সোমবার সকালে জলদস্যু নিজাম ডাকাত উপজেলার নলেরচরের জনতাবাজার থেকে নলের চরের প্রশাসনিক মেম্বার আব্দুল খালেককে (৬৫) আপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের সহযোগিতায় ছাড়া পায় খালেক মেম্বার। ১৭ আগস্ট বুধবার জলদস্যুদের হামলায় ৫ জেলে আহত হয়। এ সময় জলদস্যুরা মাছ-জলসহ প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করে।

২০ আগস্ট রাতে মেঘনা নদী থেকে জলদস্যুরা ৬টি মাছধরা ট্রলার আপহরণ করে। অপহরণকৃত ট্রলারগুলোর জন্য মুক্তিপণ নিয়েও ট্রলার মালিকদেরকে আজ পর্যন্ত তা ফিরিয়ে দেয়নি দস্যুরা।

১১ সেপ্টেম্বর মেঘনার জলদস্যু সম্রাট নাসির কেরানী র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন বলে নাসির কেরানীর পরিবার দাবি করলেও র‌্যাব তা অস্বীকার করে। এ পর্যন্ত নাসির কেনারীর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার অনুপস্থিতিতে গ্রুপ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এভাবে নাসির বাহিনীর অত্যাচার থেকে হাতিয়াবাসী কিছুটা শ‍ান্তি পেলেও শূণ্যস্থান দখলে নেয় অপর জলদস্যু বাহিনী নিজাম গ্রুপ।

এ ছাড়া জলদস্যুরা এর আগের বছরের ১৪ অক্টোবর ইব্রাহীম সরদার (৫০), কামাল উদ্দিন, আবুল খালেক, বেলাল উদ্দিন, আফছার উদ্দিন, দুলাল উদ্দিন ও রফিক উদ্দিনকে হত্যা করে।

১০ ডিসেম্বর শনিবার গভীর রাতে উপজেলা কালাম চরে জলদস্যুদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে বহু জলদস্যু নিহত হলেও তাদের লাশ পাওয়া যায়নি। একই দিন উপজেলা চেয়ারম্যান ঘাট সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয় জেলেরা বলেন, দস্যুরা লাশগুলোর পেট কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে।

১২ ডিসেম্বর হাতিয়া উপজেলায় চাঁদার দাবিতে চর কালামে নিজাম ডাকাত ও তার বাহিনী কৃষকের বাড়িতে হামলা করে হারিছ মাঝি (৩৫), বেলাল মাঝি (৩০) ও খোরশেদ মাঝিকে (৪৫) কুপিয়ে হত্যা করে।

আজ এর সপ্তম কিস্তি ...

ধর্ষণ আতঙ্ক, চরে চরে বাল্যবিয়ে

উড়িরচরে দুই বোন জলদস্যুদের হাতে ধর্ষণের শিকার হন একই রাতে এবং তা পরিবারের সবার সামনে। ঘটনার পরদিন তাদের বাবা রাতের আঁধারে জেলেনৌকার সহায়তায় তাদের নিয়ে আসেন সন্দ্বীপের এক জনপ্রতিনিধির কাছে। এখন সেই জনপ্রতিনিধির আশ্রয়েই আছেন তারা। কিন্তু জীবন থেকে মুছে যায়নি সেই বিভীষিকাময় ঘটনার স্মৃতি। পরিবারের আপনজনের সামনেও আর যাওয়া হয়নি লজ্জায়। বিষয়টি প্রকাশ করা হয়নি পারিবারিক ও সমাজিক নিরাপত্তার ভয়ে।

কেবল এই ঘটনাই নয়। এমন ভয়াবহ ঘটনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে মেঘনাপাড়ের এ চরাঞ্চলে। শুধু এরকম ঘটনা নয়, নাবালিকা  মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটাচ্ছে জলদস্যুরা। আর এ কারণে দুধের শিশুদের বিয়ে দিচ্ছেন বাবা-মা। সন্তানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে আইনের চোখে হয়ে পড়ছেন দোষী। এ কারণে স্কুলশিক্ষকরা পড়ছেন শিক্ষার্থী সংকটে। ছড়াচ্ছে যৌতুক নামের মহামারী। আখের গোছানোর সুযোগ নিচ্ছেন ইউপি সচিব।

সন্দ্বীপ পৌরসভার মেয়র জাফর উল্লাহ টিটু বলেন, ‘বর্তমানে হরহামেশাই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এ ঘটনা যেন এখন চরের মানুষের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।’

উড়িরচরের সাবেক ইউপি সদস্য এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর মেম্বার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমার খালাতো ভাই মানিক মেম্বারের ৫ম শ্রেণী পড়ুয়া মেয়েটিকে গত বছর ধরে নিয়ে গেছে খোকা বাহিনীর প্রধান মাকসুদুল আলম খোকা। কিছুদিন আটকে রাখার পর মেয়েটিকে সে বিয়ে করে এবং এ বছর মেয়েটির কোলে একটি মেয়ে সন্তানও এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা চরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। জলদস্যু বাহিনীর সদস্যরা রাতে এসে হানা দেয় ভূমিহীন পরিবারগুলোর বাড়িতে। রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যায় উঠতি মেয়েদের অথবা নির্যাতন করে যায়। আর এ কারণে কারো ঘরে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে আঁতকে ওঠে প্রতিটি পরিবার।’

স্থানীয়রা জানান, আট বছরের বেশি কেউ কন্যাসন্তান ঘরে রাখতে চান না। কিশোর বর জোগাড় করে যৌতুকের বিনিময়ে তার হাতে তুলে দেন শিশু কন্যাকে। যারা একটু প্রভাবশালী বা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন, তাদের কন্যারা উড়িরচরের বঙ্গবন্ধু জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হলেও সপ্তম শ্রেণীতে উঠলেই বিয়ে দিয়ে দেন।

উড়িরচর বঙ্গবন্ধু জুনিয়র হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হাসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ স্কুলের অধিকাংশ মেয়েই ৮ম শ্রেণীতে আসার আগে বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে পড়ে।’

তিনি বলেন, ‘চরের দুঃসহ জীবনে নিজের প্রিয় সন্তানকে দস্যুদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতেই বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেন।’

হাসান বলেন, ‘যারাও সাহস করে সন্তানদের স্কুলে পাঠায়, তারা সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকেন। স্কুলে আসা মেয়েগুলোও থাকে ভয়ে জড়সড়ো।’

এসব বিয়ের আইনি বৈধতা দেয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বাবুল।

ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাসান জানান, স্কুলে নিবন্ধিত জন্ম তারিখ এবং সনদ ফেলে দিয়ে ইউপি সচিব টাকার বিনিময়ে নতুন জন্ম সনদ তৈরি করে দেন বয়স বাড়িয়ে।

কেবল উড়িরচরই নয়। ক্যারিংচরের ভূমিহীন রাজ্জাক সারেং তার মেয়ে লাকিকে তিন বছর আগে মাইজদী গিয়ে তুলে দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের এক অচেনা চাকরিজীবীর হাতে। তিনি আজো জানেন না দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে `পরিচিত সেই অপরিচিতের ঘরে` কেমন আছে আদরের সন্তান।

এ কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজ্জাক সারেং। চারদিক ঘিরে থাকা জলদস্যুর সদস্য এবং চরদের চোখ এড়িয়ে তিনি জানান, লাকির বয়স এখন ১০ বছর হয়েছে। লাকিকে পরের হাতে তুলে দেওয়ার কারণ, তিন বছর আগে মুজিব বাজার এলাকার বাড়িতে রাতের আঁধারে হামলা চালায় দস্যু বাহিনী। তারা সেদিন তার বড় মেয়ে পাখিকে পরিবারের সবার সামনে উপর্যপুরি ধর্ষণ করে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। সকালেই তার মৃত্যু হয়।

রাজ্জাক বলেন, ‘এর এক সপ্তাহ পরই দ‍ূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে গার্মেন্টসকর্মী নারায়ণগঞ্জের আব্দুল মোনেমের হাতে তুলে দিই লাকিকে।’

রাজ্জাক বলেন, ‘আমি একবার নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্মায় গিয়ে মেয়েকে দেখেও এসেছি। কিন্তু পরের বার গিয়ে আর তাদের খুঁজে পাইনি বাসা বদলের কারণে। কিন্তু তাতে দুঃখ নাই। মা আমার যেখানেই থাকুক, জানোয়ারদের হাত থেকে তো রক্ষা পেয়েছে।’

উড়িরচরের জাহাঙ্গীর মেম্বার বলেন, ‘এ বাল্যবিবাহ দিতে গিয়ে ও যৌতুক জোগাড় করতে সর্বস্বান্ত হয় পরিবারগুলো।’

তিনি বলেন, ‘ভূমিহীন মানুষগুলো একটি কন্যাকে পাত্রস্থ করতে কমপক্ষে দুই ভরি সোনা এবং লোক খাওয়াতে বাধ্য হন। এ ছাড়া কখনো কখোনো পাত্রকে বিদেশে যেতে টাকাও দিতে হয় যৌতুক হিসেবে।’

চরের এ রকম হাজারো নির্মম গল্প শোনা যায় সন্দ্বীপ, হাতিয়ার সংবাদকর্মী, এনজিও কর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে। তাবে তারা কেউই নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার ভয়ে কারো কাছে মুখ খোলেন না। তবে তারা শুধু একটি কথাই বলেন, ‘ভাই এ যেন বাংলা সিনেমা।’

বাংলাদেশ সময় : ১৪৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০১২

আজ এর শেষ কিস্তি ...

দস্যুদের মোবাইলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

পানিশমেন্ট সেন্টার আওয়ামী লীগ অফিস!

 সন্দ্বীপ-হাতিয়া এলাকার কুখ্যাত জলদস্যু সম্রাট নিজাম ডাকাত যে দুটি মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করেন, তার প্রতিটিতেই ওয়েলকাম টিউন হিসেবে তিনি ব্যবহার করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব‍ুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।

কেবল নিজাম ডাকাত নয়, বাহার কেরানি, কামাল উদ্দিন, করিম ফিটার, ইব্রাহীম ব্যাপারী, নূরু মেম্বারসহ প্রায় সবার মোবাইলের ওয়েলকাম টিউনই বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ।

জলদস্যুরা চর এলাকা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্যারিংচর, চর বাসার, নলের চর, বয়ার চর, জাহাইজ্জার চর, উড়িরচরসহ তাদের সাম্রাজ্য ভাগ করেছে ৪৫টি ইউনিটে। এসব এলাকায় তারা প্রতিষ্ঠিত করেছে একটি করে বাজার। আর বাজারের নাম দিয়েছে আওয়ামী লীগের বর্তমান কিংবা প্রয়াত নেতা, নিজের বা নিজের সন্তান এবং শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যদের নামে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চর বাসারের নাম করা হয়েছে এক সময়ের জলদস্যু সম্রাট বাসার মাঝির নামে। ক্যারিং চরে বাসার মাঝির মেয়ের নামে আছে শাবনাজ বাজার। এই চরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে আছে মুজিব বাজার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে আছে হাসিনা বাজার। বঙ্গবন্ধুর অপর মেয়ে শেখ রেহানার নামে আছে রেহানা বাজার। শেখ রাসেলের নামে রাসেল বাজার, শেখ কামালের নামে কামাল বাজার, শেখ জামালের নামে জামাল বাজার। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামে আছে জয় বাজার ইত্যাদি। আছে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ফখরুদ্দীনের নামে ফখরুদ্দীন বাজার।

ক্যারিংচরে প্রয়াত বাসার মাঝির সদর দফতর মুজিব বাজারে। নিজাম ডাকাতের সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানি এবং মুজিব বাজার সেক্টরের কমান্ডার করিম ফিটার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা এ এলাকাকে একটি স্বতন্ত্র উপজেলা হিসেবে ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি করছি। নতুন এ উপজেলার নাম হবে মুজিব নগর উপজেলা।’

নিজাম ডাকাত এলাকার নামকরণ সব আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশ্যে রাখা সম্পর্কে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা সবাই আওয়ামী লীগ করি। বাসার মাঝি বেঁচে থাকতেই তিনি এসব নামকরণ করে গেছেন। এ কারণে চারদলীয় শাসন আমলে এমপি আজিম সাব আমাদের অনেক অত্যাচার করেছেন।’

প্রশাসনের মধ্যে আরেক প্রশাসনcarring-chor
বাজারগুলোতে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাজারেই নিজাম বাহিনীর একটি করে ‘পানিশমেন্ট সেন্টার’ (শাস্তি কেন্দ্র) আছে। কেন্দ্রগুলো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর পোস্টারে সাজানো। এসব সেন্টারকে তারা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের অফিস হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তবে কোথাও এসব সংগঠনের সাইনবোর্ড নেই। প্রতিটি অফিসকে কেন্দ্র করে আছে দস্যুদের দু’টি করে কমিটি। এলাকার বাহিনী কমান্ডারই এসব অফিসের সভাপতি এবং তার সহকারী সাধারণ সম্পাদক।

প্রতিটি অফিসেই আছে বাঁশে লাগানো মাইক। ভূমিহীনদের ধরে এনে এসব মাইকে বিচার কার্যক্রম প্রচার করা হয়। এদেরই কয়েকজন গোপনে বাংলানিউজকে জানান, মাসিক চাঁদা, মৌসুমী ধান ও বার্ষিক টাকা না দিলে ভূমিহীনদের বিচারের সম্মুখীন করা হয়। এ ছাড়া সাংবাদিক বা প্রশাসন কিংবা পুলিশের সঙ্গে কথা বললে নিজাম বাহিনীর ইউনিট কমান্ডার তার বাহিনীর মাধ্যমে ধরে নিয়ে আসে অভিযুক্ত ভূমিহীনদের। এরপর ওই এলাকার সবাইকে মাইকের মাধ্যমে নির্দেশ দেওয়া হয় পানিশমেন্ট সেন্টারে আসার জন্য। সবার সামনে বিচার করেন কমান্ডার। শাস্তি হিসেবে লাঠি দিয়ে আমানবিকভাবে পেটানো হয় অভিযুক্তকে। এ কার্যক্রম মাইকের মাধ্যমে শোনানো হয় বাড়িতে থাকা নারীদেরও। মৃত বাসার মাঝি চালু করে গেছেন এই বিচার প্রক্রিয়া।

উপজেলা কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন, ‘চর জেগে ওঠার আগেই জলদস্যুরা এসব চরের দখল নিয়ে নেয়। আমি শুনেছি এরা ইউনিটভিত্তিক জমি ভাগ করে ভূমিহীনদের জায়গা দেওয়ার নামে ভূমিহীনদের কাছ থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আদায় করে। এরা জমি বরাদ্দের সময় চালাকি করে এলাকার নাম রাখে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের নামে। প্রতিটি এলাকায় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি, স্কুলের জন্য জায়গা রাখে।’

ডাকাতদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে কেউ প্রশাসনের কাছে কোনো অভিযোগ করে না। হাতিয়া থেকে এক একটি চরে যেতে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার মেঘনা পাড়ি দিতে হয়। তাছাড়া চরের কেউই কারো বিরুদ্ধে মুখ খোলে না অত্যাচরের ভয়ে। প্রশাসন চলে এলেই তাদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে নতুন একজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেখানে বাস করতে দেওয়া হয়। সে কথা না শুনলে তাকেও উচ্ছেদ করে অন্য কাউকে ...। এভাবেই চলে চরের জীবন।’

তিনি বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় প্রশাসনের পক্ষেও চরবাসীকে সাহায্য ও নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়।’

চরে শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে গেছেন মৃত বাসার মাঝি। নিজাম বাহিনীর প্রধান নিজাম এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের মুরুব্বী এই চরে ৪৫টি স্কুল, ৪৫টি মাদ্রাসা, ৪৫টি মসজিদ, ৪৫টি পার্টি অফিস ও ১টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি জীবিত থাকার সময় নিজ খরচে এসব প্রতিষ্ঠান চালাতেন। এখন আমি এগুলো দেখাশোনা করি।’

নিজাম বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড বাহার কেরানি বলেন, ‘আমরা চরের ভূমিহীনরা এ সব প্রতিষ্ঠান চালাই। এজন্য পরিবারপ্রতি মাসে ৫০/১০০ টাকা নেওয়া হয়। চৌধুরী সাব (নিজাম) আমাদের প্রতিটি মাদ্রাসায় ৪টি করে মাইক, একটি করে সোলার প্যানেল দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতিটি স্কুলের ২ জন করে মাস্টারের বেতন ৫ হাজার করে এবং মাদ্রাসায় একজন বাংলা মৌলানা এবং একজন আরবী মৌলানার বেতন দিতে হয় ৭ হাজার করে।’

তিনি বলেন, ‘গরমের দিন এলেই চরে মহামারী আকারে ডায়রিয়া শুরু হবে। তখন স্কুল বন্ধ করে এখানে হাসপাতাল বানানো হবে। নিজাম চৌধুরী নিজ টাকায় এ হাসপাতাল চালাবেন।’

এইসব মাদ্রাসা ও মসজিদে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিজাম ডাকাতের জন্য দোয়া কামনা করে মিলাদ ও দোয়া পাঠ করা হয় বলে জানালেন মুজিব বাজার মাদ্রাসার ছাত্র আল-আমিন। ডাকাতের জন্য দোয়া করেন কেন, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিজাম চৌধুরী আমাদের মাঝে মাঝে মহিষ জবাই করে খাওয়ায়, তাছাড়া আমাদের হুজুর মিলাদ পড়ায়, আমরা পড়ি।’

চরে চলাচলের জন্য কোনো রাস্তা নেই। দস্যুরা নিজেদের চলাচলের জন্য একটি পায়ে হাঁটা রাস্তা বানালেও বর্ষা মৌসুমে তা থাকে পানির নিচে। মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে দেখা গেল নিজের পা-ই এখানকার একমাত্র যান। কয়েকটি বাজারে একটি করে নলকূপ থাকলেও এ ব্যবস্থা নেই কোনো বাড়িতে। কাঁচা কূপই এখনকার আড়াই লাখ মানুষের একমাত্র পানির ব্যবস্থা। তাও সব বাড়িতে নেই। খোলা আকাশের নিচের দূষিত পানি খেয়ে সারা বছরই কলেরা আমাশয়ের মতো মহামারীতে ভোগেন চরের সাধারণ ভূমিহীনরা।

হাতিয়া উপজেলা কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান বলেন, ‘চরে আমাদের দু’টি প্রশাসনিক কমিটি আছে। এদের মাধ্যমে এসব স্কুলে সরকারের তরফ থেকে বই সরবরাহ করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘এ বছর হাতিয়া উপজেলায় ১৮টি নলকূপ এসেছে। এ দিয়ে কয়জনের কাজ হবে!’

চরে সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে
চরে সংবিধান লঙ্ঘন হচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন হাতিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখানে সরকারের দু’টি প্রশাসনিক কমিটি আছে, তা দিয়েই কাজ চলছে। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ থাকলেও দীর্ঘ দিন ধরে এখানে নির্বাচন হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের আইন অনুযায়ী এতদিন নির্বাচন না দিয়ে প্রশাসক দিয়ে স্থানীয় সরকার চালানো অসাংবিধানিক।’

এ বিষয়ে উপজেলা কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত নোট পাঠিয়েছেন বলেও জানান।

চরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড
জেলেদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা, ছিনতাই, নৌ-ডাকাতি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ছাড়াও চরের সমগ্র অর্থনীতির দখল জলদস্যুদের হাতে। চরের ৪৫টি ছোট ছোট বাজারের সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক জলদস্যুরা। এ ছাড়া মাছ ঘাট, জেলে নৌকা, দাদন ও মাছের ব্যবসা জলদস্যু এবং তাদের মদদদাতাদের দখলে।

স্থানীয় ভূমিহীনরা জানান, কেবল তাই নয়, বর্ষা মৌসুমে ভূমিহীনরা মাছ ও কাঁকড়া ধরেন। যা জলদস্যুর এজেন্টদের কাছে পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হন তারা। এ ছাড়া প্রতিটি পরিবারকে প্রতি মৌসুমে দাগ প্রতি (১৬০ শতাংশ) ৫ মণ ধান দিতে হয়। গরু বা মহিষ প্রতি দিতে হয় ৩০০ টাকা (মাসে)। এর অন্যথা হলে পানিশমেন্ট সেন্টারে চলে নির্যাতন।





 
ছাত্রলীগ 'সোনার ডিম পাড়া হাঁস'  
পাভেল হায়দার চৌধুরী

ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যেন এক জাদুর কাঠি, যার ছোঁয়ায় ছাত্রনেতারা রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান কথিত আছে, ১৯৯৪ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনের মাধ্যমে এনামুল হক শামীম-ইসহাক আলী খান পান্না কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে শুরু হয় টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, তদবির, কমিটি বাণিজ্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে উপঢৌকন নেওয়াসহ নানা অনৈতিক কার্যকলাপ
ছাত্রলীগের রাজনীতি করার সুবাদে বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা অঢেল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন এই তালিকার ওপরের দিকে আছে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম, লিয়াকত শিকদার, মাহমুদ হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনের পাশাপাশি বর্তমান সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমের নাম কালের কণ্ঠের এক অনুসন্ধানে ছাত্রলীগের সাবেক বর্তমান নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়
ছাত্রলীগের একাধিক সাবেক নেতা মনে করেন, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সালের শামীম-পান্না কমিটি থেকেই মূলত ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে বিত্তশালী হওয়া ভোগবিলাসের সংস্কৃতি শুরু ধারাবাহিকভাবে এর পরের নেতারাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে টেন্ডারবাজি, নিয়োগ, তদবির কমিটি বাণিজ্য, ঠিকাদারিসহ নানা কাজে পকেট ভরেছেন রাজনীতি না করেও টাকার বিনিময়ে এই সংগঠনে নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার নজির রয়েছে অনেক সূত্র জানায়, বর্তমানে ছাত্রলীগের ইউনিট কমিটির মধ্যে ঢাকা মহানগর, ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, তেজগাঁও কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতারা 'নেতা' হয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে
এদিকে সাবেক হয়ে যাওয়ার পরও এখনো ছাত্রলীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন বলে কয়েকজনের নামে অভিযোগ উঠেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম এনামুল হক শামীম, লিয়াকত শিকদার সাইফুজ্জামান শিখর এঁদের আস্থাভাজন হতে পারলেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করার টিকিট মিলে বলে জানা গেছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগের সাবেক এক সহসভাপতি এসব তথ্য জানিয়ে আরো বলেন, ছাত্রলীগের গত সম্মেলনই এর প্রমাণ
ওই নেতা আরো জানান, কার্যত শামীম, লিয়াকতসহ সাবেক বেশ কয়েকজন নেতার নির্দেশেই চলে ছাত্রলীগের কার্যক্রম সরকারের এমন কোনো মন্ত্রণালয় নেই, যেখানে ছাত্রলীগের নেতাদের টেন্ডার বাণিজ্য নেই বিশেষ করে বিদ্যু ভবন খাদ্য ভবনে ছাত্রলীগের নেতাদের আধিপত্য বেশি ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রভাব খাটিয়ে কাজ আদায় করে নেন এসব নেতা তিনি জানান, বর্তমান সরকারের আমলে এই কয়েকজন নেতা মিলে সরকারের 'একটি বাড়ি একটি খামার' প্রকল্প থেকেই কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন
ছাত্রলীগের রাজনীতির এই অবস্থা সম্পর্কে সাবেক ছাত্রনেতা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ছাত্রলীগের আগের রাজনীতি আর এখনকার রাজনীতি এবং নেতাদের মধ্যে বিশাল ফারাক ছাত্রলীগের বর্তমান নেতাদের মধ্যে নীতি-আদর্শ নেই তিনি বলেন, 'তারা নেতা হয়েই বিত্ত-বৈভব আর আরাম-আয়েস করার স্বপ্ন দেখে মূলত নব্বই দশকের পরই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ভিন্ন ধারা আসতে শুরু করে'
প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের আরেক সাবেক নেতা নুরে আলম সিদ্দিকী বলেন, স্বাধীনতার অপর নাম ছাত্রলীগ বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, 'বর্তমান ছাত্রলীগ নিয়ে আমি কোনো বক্তব্য দেব না এদের নিয়ে কোনো কথা বলার আগ্রহ আমার নেই'
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, বর্তমান কমিটির দুই শীর্ষ নেতা নারায়ণগঞ্জের রূপপুরের কমিটি অনুমোদন দিয়েছেন ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকা কলেজ স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের কমিটি গঠনেও মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলায় কমিটি দেওয়া হয় ১০ লাখ টাকায় পরে বিতর্কিত সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয় এসবের বিনিময়ে প্রভাবশালী ওই ছাত্রনেতাদের কেউ বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, কেউ নামি-দামি গাড়ির মালিক হয়েছেন তবে গাড়ি বা বাড়িবিলাসের কথা অস্বীকার করে ছাত্রনেতারা দাবি করেন, ব্যবহার করা গাড়ি ফ্ল্যাট তাঁদের আত্মীয় বড় ভাইদের তাঁরা ব্যবহার করার জন্য নিয়েছেন পরে ফেরত দিয়ে দেবেন বিশাল ফ্ল্যাটের মালিক এক ছাত্রলীগ নেতার দাবি, ওটা তাঁর ভাড়া করা ফ্ল্যাট
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংগঠনের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জানান, সমুদ্রসীমা বিজয় উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ছাত্রলীগের দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষে কয়েক কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রায় সিংহভাগ টাকাই দুই শীর্ষ নেতার পকেটে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে জানা গেছে, সেই অর্থ দিয়ে বর্তমান কমিটির সভাপতি সোহাগ নাজমুল দুজনই এলিয়ন ব্র্যান্ডের দুটি প্রাইভেট কার কিনেছেন
প্রসঙ্গে সিদ্দিকী নাজমুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, নীতি-আদর্শ বজায় রেখে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন তদবির টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগের কথা তিনি অস্বীকার করেন ছাত্রনেতা হয়েও গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আমার ব্যবহার করা গাড়ি এক বড় ভাইয়ের, ফেরত দিয়ে দেব ফ্ল্যাট সম্পর্কে বলেন, এক আত্মীয়ের বাসায় থাকি'
ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে সৌভাগ্যই তাঁর পেছনে পেছনে ছুটেছে টেন্ডারবাজি, তদবিরসহ নানা কৌশলে ফ্ল্যাট কয়েকটি গাড়ির মালিক এই নেতা রাজধানীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা রয়েছে তাঁর
বর্তমান কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা বলেন, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এনামুল হক শামীম লিয়াকত শিকদারই বর্তমান ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রক তাঁদের ম্যানেজ না করে ছাত্রলীগের নেতা হওয়া যায় না তাই রাজনীতির চেয়ে 'ভাই'দের ম্যানেজ করার চেষ্টা করি বেশি তাঁরা আরো জানান, টেন্ডারবাজি, তদবির, কমিটি বাণিজ্যের মাধ্যমে ছাত্রলীগের নেতারা অনেক টাকার মালিক হয়েছেন এটা জানি তার পরও রাজনীতিতে টিকে থাকতে তাঁদের কথা শুনতে হয় এনামুল হক শামীম বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল আদায়ের ইজারাও নিয়েছেন জানা গেছে, প্রভাব খাটিয়েই তিনি কাজ বাগিয়েছেন রাষ্ট্রায়ত্ত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে নিয়োগ বাণিজ্য চালানোর অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে
লিয়াকত শিকদার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা ছাত্রলীগকে সব সময় 'তুরুপের তাস' মনে করেন ছাত্রলীগের সাবেক বর্তমান নেতার অনেকের কাছেই লিয়াকত শিকদার ভবিষ্য নেতা বানানোর কারিগর হিসেবে পরিচিত তাই সকাল-বিকেল অনেক ছাত্রনেতাই তাঁর বাসায় যান সালাম করে দোয়া নিয়ে আসেন জানা গেছে, গত এক দশকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী যত ইউনিট কমিটি হয়েছে, তার সবই লিয়াকতের ইশারায় বদৌলতে বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তিনি ছাত্রলীগের যখন যে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ইউনিট কমিটি দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধু দাপ্তরিক প্যাডে স্বাক্ষর করাই ছিল তাঁদের কাজ কমিটিতে নাম বসান সাবেক নেতারা ছাত্রলীগের দাপটে লিয়াকত শিকদার রাজধানীতে ফ্ল্যাট, গাড়ি, প্লটের মালিক হওয়া এবং ঠিকাদারি ব্যবসাসহ বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অল্প সময়ে বিত্তশালী হয়ে উঠেছেন গত বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় স্টেডিয়ামের সংস্কারকাজসহ ক্রীড়া পরিষদ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন টেন্ডারের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁরই কমিটির এক সহসভাপতি আরো জানা গেছে, এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে রয়েছে কম্পিউটার ওয়ার্ল্ড বিডি নামে তাঁর একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পাওয়ার কানেকশন নামে রাজধানীর আকরাম টাওয়ারে একটি অফিসও রয়েছে এই সাইনবোর্ডের মাধ্যমে মূলত বিদ্যু ভবনের টেন্ডার বাগিয়ে নেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায় সেগুনবাগিচায় রয়েছে লিয়াকতের সুরম্য ফ্ল্যাট
লিয়াকত শিকদার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা অস্বীকার করে কালের কণ্ঠকে বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা নতুন ষড়যন্ত্র ছাত্রলীগের নেতা বানানো এবং মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগের নেতারা নির্বাচিত হয় সংগঠনের নিজস্ব নিয়ম-নীতিতে এখানে আমার কোনো ভূমিকা নেই সকাল-বিকেল তাঁর বাসায় ছাত্রনেতাদের উপস্থিতির কথাও অস্বীকার করেন তিনি তবে এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকার কথা স্বীকার করেন'
মাহমুদ হাসান রিপন ২০০৪ সালে ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েই শুরু হয় তাঁর ভাগ্যবদল মূলত নিয়োগ বাণিজ্য, কমিটি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজিই ছিল তাঁর আয়ের প্রধান ৎস বর্তমান সরকারের আমলে এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে রিপনের প্রভাব নেই ২০১১ সাল পর্যন্ত নেতৃত্বে থাকাকালে প্রতিদিন সকালে উঠেই সচিবালয়ে তদবিরের কাজে যেতেন বলে জানা গেছে রাজধানীর অভিজাত এলাকার ফ্ল্যাটে বসবাস, কোটি টাকা ব্যয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করা, গাইবান্ধার সাঘাটা থানায় বিশাল বাড়ি নির্মাণ, দামি গাড়ি, নামে-বেনামে বিপুল অঙ্কের ব্যাংক ব্যালান্স_এত কিছুর মালিক হয়েছেন ছাত্রনেতা হওয়ার সুবাদে দুদক তাঁর সম্পদের অনুসন্ধানও করছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে
জানা গেছে, রিপন বর্তমান সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার নিয়োগ টেন্ডারকাজ করেছেন দলীয় প্রভাব খাটিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন টেন্ডার বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এই নেতা তাঁর সঙ্গে মিলে কাজ করেছেন সাধারণ সম্পাদক রোটন এভাবে রোটনও অনেক টাকার মালিক হয়েছেন বলে বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আয় হয়েছে রোটনের তাঁর ফ্ল্যাট রয়েছে পান্থপথের স্কয়ার হাসপাতালের বিপরীত পাশে
তদবির, টেন্ডার বাণিজ্য ছাড়াও ছাত্রলীগ সভাপতি থাকাকালে রিপন সারা দেশে কমিটি দিয়েই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন জানা যায়, ছাত্রলীগের প্রতিটি ইউনিটে কমিটি দেওয়ার সময় ১০ থেকে ২০ লাখ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশি টাকার বিনিময়ে পদ দিয়েছেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের এক ছাত্রনেতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে পদ না দেওয়ায় তাঁর রোষানলেও পড়েন রিপন বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদ হাসান রিপন পরে কথা বলবেন জানিয়ে আর কোনো কথা বলেননি রিপনের সময়কার সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনও অবৈধ পন্থায় অর্জিত টাকার ভাগ নিতেন
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম_দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ২০১১ সালে জাতীয় সম্মেলনে তাঁরা নেতৃত্বে আসেন অভিযোগ রয়েছে, উত্তরসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁরাও মাত্র এক বছরের ব্যবধানেই বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন তাঁদেরও অর্থের ৎস টেন্ডার তদবিরবাজি, কমিটি বাণিজ্য এবং ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক চাঁদা উপঢৌকন আদায় সম্প্রতি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল উপঢৌকন হিসেবে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে দামি একটি গাড়ি পেয়েছেন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বসবাস করেন সভাপতি সোহাগ থাকেন বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে


 নকল ওষুধের ব্যবসা, মৃত্যুফাঁদ
 
ঢাকা: বেড়েই চলেছে নকল ও ভেজাল ওষুধের রমরমা ব্যবসা। একই সঙ্গে বাড়ছে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা। মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ডাক্তারের ফি ও টেস্টের (রোগ নির্ণয়) খরচের ‍আতঙ্কে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে যান কম, বেশিরভাড় ক্ষেত্রেই তারা সরাসরি চলে যান ওষুধ বিক্রেতার কাছে। তার কাছে রোগের বিবরণ দিয়ে ওষুধ কিনে নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, কেনার সময়েও খোঁজেন কম দামি ওষুধ। আর এরই সুযোগ নিচ্ছে ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীরা।

যখন ওষুধ সেবন করা হয়, তখন বোঝার উপায় থাকে না ওষুধটি নকল নাকি আসল। ওষুধ সেবনের পর কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া না গেলে হয়ত রোগীর কল্পনাতেও আসে না তা নকল ছিল। ফের ডাক্তারের পরামর্শ নেয় অথবা চুপচাপ দীর্ঘ দিন বয়ে বেড়াতে হয়।

এ প্রসঙ্গে গণস্বাস্থ্য জনহিতকর দাতব্য ট্রাস্ট্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী বলেন, ভেজাল ওষুধ দুই ধরনের। একটি হচ্ছে, সাব-স্ট্যান্ডার্ড। প্রয়োজনীয় উপাদান পরিবর্তন করে এ ধরনের ওষুধ তৈরি করা হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে, নকল বা কাউন্টারফিট ওষুধ।

সাব-স্ট্যান্ডার্ড ওষুধ ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি একভাবে তৈরি করে আর ভেজালকারীরা তা বাজারজাত করে অন্যভাবে। যেমন একটি ওষুধে এক চামচ চিনি দেওয়ার কথা থাকলেও দেওয়া হয় আধা চামচ ইত্যাদি।

নকল ওষুধের ক্ষেত্রে ওষুধের জেনারেশন পরিবর্তন করা হয়। বলা হলো, এটি থার্ড জেনারেশনের ওষুধ। অথচ ভেতরে দেওয়া হয়েছে ফার্স্ট জেনারেশনের উপাদান।

নকল ওষুধের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যাপার ঘটে। ভেজাল ওষুধ তৈরি করে অন্য কোম্পানির নামে চালানো হয়। আবার একটি বড় কোম্পানির মোড়কে ওষুধ তৈরি করলে, তা ধরে কে? দেশে একটিমাত্র কারখানা রয়েছে যেখানে খালি ক্যাপসুল (এমটি হার্ড জিলোটিন ক্যাপসুল) তৈরি করা হয়। এক বাক্স খালি ক্যাপসুলের দাম ১২ হাজার ৬৭৫ টাকা। এটা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।

বিএনপি সরকারের গত মেয়াদে শেষের দিকে তৈরি ওষুধনীতিতে বলা হয়, ১১৭টি ওষুধের দাম বাড়বে। এছাড়া কোনো ওষুধের দাম বাড়বে না (ইনডিকেটিভ প্রাইস)। সরকার ওষুধের দামের স্বীকৃতি দিলেই কেবল তা বাজারে ছাড়া যাবে। অথচ কেউ-ই মানছে এ নীতি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এতে একই ওষুধ ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনকারী নানা দামে বাজারজাত করছে। যেমন ওমিপ্রাজল (২০ এমজি) আলবিয়ন (আলবিয়ন ল্যাবরেটোরিজ লি.) বাজারজাত করছে লোটিল-২০ নামে, দাম মাত্র এক টাকা। একই ওষুধ প্রোবিটর-২০ নামে বাজারজাত করছে স্যানডোজ, দাম সাত টাকা। অন্যান্য উৎপাদনকারীদের কেউ তিন টাকা, কেউ চার টাকা, কেউ পাঁচ টাকায় বিক্রি করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার বাজারে প্রতি ১০টি ওষুধের প্রায় তিনটিই নকল।
অল্প খরচে বেশি লাভ হওয়ায় প্রতারকদের কাছে ভেজাল ওষুধ ব্যবসার আকর্ষণ বাড়ছে। ভেজালকারীরা শুধু ট্যাবলেট ও ক্যাপস্যুল ভেজাল করতে বেশি পছন্দ করে। কারণ এগুলো শুকনো ওষুধ ও ঝামেলা কম।

ভেজাল সম্পর্কে ফার্মাসিস্ট মো. খলিলুর রহমান বলেন, “যেসব ওষুধ তরল প্রিজারভেটিভ মিশিয়ে বোতলজাত করতে হয়, বেশি মুনাফা লাভের জন্য সেগুলোয় ক্ষতিকর ও কম দামি প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয়।  যেমন, চোখের ড্রপ উৎপাদনে প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্ষতিকর বেনজাইল ক্লোরিয়াম ক্লোরাইড। অথচ প্রিজারভেটিভ হিসাবে ব্যবহার করা প্রয়োজন সোডিয়াম পারবোরেট।

তিনি বলেন, “দেশে এখন থার্ড জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিক বাজারজাত হচ্ছে। তবে থার্ড জেনারেশনের লেবেল লাগিয়ে ভেজালকারীরা যদি সেকেন্ড কিংবা ফার্স্ট জেনারেশনের ওষুধ বাজারজাত করে, তা দেখার কেউ নেই। ভোক্তাকে ওষুধ উৎপাদনকারীদের লেবেলে আস্থা ও বিশ্বাস করে ওষুধ খেতে হবে। যেমন সেকেন্ড জেনারেশনের সেফিক্সাইমের নামে কোনো উৎপাদনকারী যদি ফার্স্ট জেনারেশনের অ্যামোক্সিসিলিন বাজারজাত বা বোতলজাত করে, তা দেখার বা তদারকি করার কেউ নেই। ভেজালকারীদের পাশাপাশি অনেক সময় উৎপাদকারীরাও এই ধরনের কাজ করে থাকেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মো. খলিলুর রহমান আরো অভিযোগ করেন, ওষুধের ওজন দেখারও কেউ নেই। বেশিরভাগ উৎপাদনকারীর ১৫০ এমজির রেনিটিডিনের ওজন ১১০ এমজি। অর্থাৎ দুই টাকা দাম নিয়ে তারা ভোক্তাকে দিচ্ছে দেড় টাকার রেনিটিডিন।

কী কী ওষুধ ভেজাল হচ্ছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, থার্ড জেনারেশনের অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে এজিথ্রোমাইসিন, সেফিক্সাইম, সেফট্রিয়াক্সন অন্যতম।

গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের মধ্যে ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যান্টাপ্রাজল অন্যতম। এসব ওষুধই চিকিৎসকরা বেশি লেখেন এবং রোগীরা বেশি পছন্দ করেন।
জ্বর ও ব্যথা নিবারণের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওষুধ প্যারাসিটামল। ট্যাবলেট আকারে পূর্ণবয়স্ক মানুষের এবং সিরাপ আকারে শিশুদের জন্য এটি তৈরি করা হয়।

এছাড়া ওষুধ কোম্পানিগুলো শিশুদের ব্যবহারের জন্য প্যারাসিটামল তৈরি করে থাকে। প্যারাসিটামল পানিতে মেশে না। তাই সিরাপ তৈরি করতে সাধারণত প্রপাইলিন গ্লাইকল (দ্রাবক হিসেবে) ব্যবহার করা হয়। ইথাইলিন গ্লাইকল ও ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকল হচ্ছে প্রপাইলিন গ্লাইকলের সমগোত্রীয়, তবে ক্ষতিকারক। প্রপাইলিন গ্লাইকলের দাম বেশি হওয়ায় একশ্রেণির অসাধু ওষুধপ্রস্তুতকারী শিশুদের ওষুধে এসব (ইথাইলিন গ্লাইকল ও ডাই-ইথাইলিন গ্লাইকল) বিষ মেশায়। এর ফলে প্রতি বছর অসংখ্য শিশু কিডনি রোগে মারা যায়।

এছাড়াও নকল করা হচ্ছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত রোগে ব্যবহার করা কেভিনটল ট্যাবলেট। নকল কাঁচামাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ হাইড্রোকরটিসন ইনজেকশন (এন্টি-অ্যালার্জিটিক)।

মাত্র ৩০ টাকা মূল্যের অ্যান্টিবায়োটিক অ্যামোক্সিসিলিন ড্রাই সিরাপের বোতলে দামি অ্যান্টিবায়োটিক ড্রাই সিরাপের লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। নকল হচ্ছে যক্ষ্মা রোগের ওষুধ রিফিমপিসিন ট্যাবলেটও।
৮ থেকে ১০ টাকার জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ ডিপোপ্রোভেরার লেবেল বদলে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে ভেজাল ডিপোমেট্রাল। এসব ভেজাল ওষুধ খেয়ে মাতৃত্ব হারাচ্ছেন বহু নারী।

আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রফিকেক্সিব গ্রুপের ওষুধও বিক্রি হচ্ছে (ব্যথার ওষুধ) অনেক মফস্বলে। চিকিৎসকদের মতে, এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রাণহানিরও আশঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া জীবনরক্ষাকারী আরও বেশকিছু নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদানে তৈরি ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে বলে জানা গেছে।

এর মধ্যে রয়েছে রক্ত স্বল্পতাজনিত সমস্যায় দেওয়া হয় আয়রন হিমোগ্লোবিন সিরাপ, ট্রাইডাল ইনজেকশন (চর্ম রোগ সংক্রান্ত সমস্যায়), জেনটোমাইসিন গ্রুপের জেনটোসিনাস ইনজেকশন (ঘা শুকানোর জন্য),  গ্রাইপ ওয়াটার সিরাপ (পেট ব্যথার জন্য), সালবিউটামল গ্রুপের ওষুধ ভেনটোলিন (শ্বাস কষ্টের জন্য), অ্যান্টিবায়োটিক মাইসেফ, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম গ্রুপের ওষুধ ডাইক্লোফেনাক (ব্যথার জন্য দেওয়া হয়), বেটনোভেট (চর্ম রোগের জন্য দেওয়া হয়), মেথারজিন ট্যাবলেট (ব্যথার ওষুধ), ডায়াবেটিসের ইনসুলিন, নিউরোবিওন (ভিটামিন বি১ বি১২ বি৬), ভিটামিন বিটেক্স (ভিটামিন বি১ বি১২ বি৬), রেনিটিডিন গ্রুপের ওষুধ গ্যাসের জন্য দেওয়া হয় রেনিটিডিন, জেনটামিনসহ (ইনফেকশনের মলম) বিভিন্ন মোড়কের সিরাপ ও ক্যাপসুল। এছাড়াও রয়েছে ক্যানিকিড ইনজেকশন, ইনফেরন ইনজেকশন ইত্যাদি।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, রাজধানীতে ১৫০ ফ্ল্যাটে অস্বাস্থ্যকর-নোংরা পরিবেশে ভেজাল ওষুধ তৈরি ও প্যাকেটজাত করা হচ্ছে। মিরপুর, পল্লবী, গুলশান, মিটফোর্ড, রায়েরবাজার, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মনিপুরীপাড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় কয়েকটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত।

ওষুধ প্রশাসন সূত্র জানায়, সারা দেশে এলোপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে ২৪৬টি, ইউনানী ২৬১টি, আয়ুর্বেদিক ১৬১টি ও হোমিওপ্যাথি ওষুধ কোম্পানি ৭৭টি।

একটি ওষুধ একাধিক কোম্পানির তৈরির অনুমতি আছে। যেমন, শুধু প্যারাসিটামল ট্যাবলেট তৈরি করে ১০৬টি কোম্পানি এবং প্যারাসিটামল সিরাপ তৈরি করে ২১টি কোম্পানি।

এদিকে, এই ওষুধ বাজারজাত করা হচ্ছে দেশের প্রায় সোয়া দুই লাখ ওষুধের দোকানে। এর মধ্যে লাইসেন্স রয়েছে মাত্র ৬০ হাজার দোকানের।
বাকি দোকানগুলোর কোনো লাইসেন্স নেই। ফলে গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধের পরিবর্তে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা অন্যন্য ওষুধ বিক্রি হচ্ছে যা খেলে জীবন বিপন্ন হতে পারে।

বর্তমানে দেশে বছরে ওষুধ বিক্রি হচ্ছে ৫ হাজার কোটি টাকার। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, এর মধ্যে আড়িইশ কোটি টাকার ওষুধ ভেজাল হচ্ছে। ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কোম্পানিই ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে।

সম্প্রতি একটি খবরের কাগজে দেওয়া সাক্ষাতকারে বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান স্বীকার করেন, “বাজারে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। ভেজাল ওষুধ খেয়ে মানুষ মারাও যাচ্ছে।”

“তবে এ কাজের সঙ্গে যারা জড়িত তারা কেউই ওষুধশিল্প মালিক সমিতির সদস্য নয়। প্রতিটি সদস্য প্রতিষ্ঠানের ওষুধের মান ঠিক রাখার ব্যাপারে আমরা সচেতন।”

তিনি বলেন, “এ ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হলে সরকারকে কঠোর হতে হবে। দেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে অবৈধ ফার্মেসি। মোটা অঙ্কের মুনাফার আশায় এসব ফার্মেসিতে নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে ওষুধ প্রশাসনে বেশ কয়েকবার আবেদন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি অভিযোগ করেন তিনি।”

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, কম্বোডিয়াতে কম করে হলেও দুই হাজার ৮০০ দুর্নীতিবাজ ওষুধ ব্যবসায়ী রয়েছে। ২০০৩ সালে কম্বোডিয়ায় এক হাজার নকল ও ভেজাল ওষুধ আটক করা হয়। ভেজাল ওষুধ উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নাইজেরিয়া (২৩ শতাংশ)।

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও নকল ও ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্যও কম নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০০১ সালের হিসাব মতে, বিশ্বেও মোট নকল ও ভেজাল ওষুধের ৩৫ শতাংশ শুধু ভারতেই উৎপাদন হয়। ভারতে চার হাজার কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি হয়, যা মোট ওষুধ উৎপাদনের ২০ শতাংশ।

জাতিসংঘ ওষুধ ও অপরাধ কার্যালয়ের (ইউএনওডিসি) এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভেজাল বা নকল ওষুধ খাতে কেবল এশিয়া ও আফ্রিকাতেই বছরে প্রায় ১৬০ কোটি মার্কিন ডলারের বাণিজ্য হয়। পাশাপাশি বিশ্বের প্রায় সব জায়গায়ই এ অপরাধ ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউএনওডিসি থেকে আরো জানা গেছে, এশিয়া ও আফ্রিকার বাজারে সংক্রমণ প্রতিরোধী ওষুধের প্রায় ৫০ থেকে ৬০ শতাংশেই উপাদানের মিশেলে অনুপাত ঠিক থাকে না।

সম্প্রতি জনপ্রিয় মেডিক্যাল সাময়িকপত্র ল্যানসেটে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রবন্ধের মাধ্যমে জানা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নকল ও ভেজাল ম্যালেরিয়ার ওষুধের কারণে প্রতিবছর এক লাখ মানুষ মারা যায়।
এ অঞ্চলে এক-তৃতীয়াংশ ম্যালেরিয়ার ওষুধ নকল। গবেষকরা দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার সাতটি দেশে পাঁচ ধরনের এক হাজার ৩৭টি ম্যালেরিয়ার ওষুধের নমুনা পরীক্ষা করে দেখতে পান, এসব ওষুধের ৩৬ শতাংশ নকল। এসব নমুনার  মধ্যে ৩০ শতাংশ ওষুধে কোনো উপকরণই (অ্যাকটিভ ইনগ্রিডিয়েন্ট) নেই।

সাব-সাহারা অঞ্চলের ২১টি দেশে ছয় প্রকার দুই হাজার ৫০০টি ওষুধের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগই নকল এবং শতকরা ৩০ ভাগই নিম্নমানের বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়।
ওষুধের দাম লাগামছাড়া, মানুষ জিম্মি
ঢাকা: মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে অত্যন্ত জরুরি বিভিন্ন ওষুধের দাম। সাধারণ কোনো অসুখ নিয়ে কোনোমতে ডাক্তারের কাছে যেতে পারলেও ফার্মেসিতে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। অথবা গেলেও দাম জিজ্ঞেস করার পর তা কেনার সামর্থ্য অনেকেরই থাকে না।
অনেকের ধার-দেনা করার সামর্থ্য থাকলেও নিম্নবিত্তদের রোগ চেপে রাখতে হয়। দীর্ঘদিন শরীরের রোগ পুষে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না তাদের। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিম্নবিত্ত মানুষের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম।।

ওষুধ প্রশাসনের ১১৭টি অত্যাবশকীয় ওষুধের একটি তালিকা রয়েছে। এর অন্তর্ভুক্ত সালবিউটামল গ্রুপের ব্রডিল, সালটলিন, ভেনটোলিন (ঠাণ্ডাজনিত রোগে দেওয়া হয়)। এ ওষুধের দাম ছিল ১৬ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ২৩ টাকায়। প্রায় ৪৩ শতাংশ দাম বেড়েছে।

প্রোপ্রানল হাইড্রোক্লোরাইড-ইন্ডেভার (হাইপার টেনশন বা অস্থিরতাজনিত রোগে দেওয়া হয়) ১০ মিলিগ্রাম (এমজি) ১০০টির বক্স বিক্রি হতো ২৪ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ৫১ টাকায় আর ৪০ এমজি ৩৪ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬ টাকা।

স্কয়ার, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো, ইবনেসিনা কোম্পানির অ্যান্টাসিড ট্যাবলেট (গ্যাস্ট্রিক সমস্যায় ব্যবহার্য) ১০টির পাতা বিক্রি হতো ১০ টাকায়, এখন সেটা বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। মাঝখানে ১৫ টাকায় বিক্রি হলেও আবারও বেড়েছে।

স্কয়ারের অ্যান্টাসিড সিরাপের দাম ৫৫ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।

পাশাপাশি একমি, ইনসেপ্টা, বেক্সিমকো এবং ইবনেসিনা কোম্পানির অ্যান্টাসিড সিরাপের দামও ৭৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

ব্যথার সমস্যায় ব্যবহার্য ডাই-ক্লোফেনাক, কিটোরোলাক, আইবোপ্রফেন গ্রুপের ওষুধের (ইটোরিক্স, ইটো, নো-পেইন, কলিকন, বুটাপেইন, রোলাক) দাম প্রতিটি কোম্পানিই বড়িয়েছে এক টাকা করে।

ক্যালসিয়াম ক্যাপসুলের দাম ৪২০ টাকা থেকে একমাসের ব্যবধানে ৬০০ টাকা করা হয়েছে। আবার একই ওষুধ চীনা কোম্পানির স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০০ টাকায়। দোকানিদের কাছ থেকেই এতথ্য জানা গেছে।

নভো-নর্ডিকস কোম্পানির ইনসুলিনের (ডায়াবেটিসের জন্য) দাম ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এখন বিক্রি করা  হচ্ছে ১০০ টাকায়।

এছাড়া স্কয়ার, বেক্সিমকো, পপুলার, ইনসেপ্টা, এরিস্টোফার্মা, এসিআই কোম্পানির ইনসুলিনের (১০০ আইও) দাম নেওয়া হচ্ছে ৪১৫ টাকা।

ফার্মাসিস্ট ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধনীতির তোয়াক্কা না করে দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। নিত্য ব্যবহার্য ওষুধ পর্যন্ত চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। মৌলিক চহিদা থেকেই বঞ্চিত তারা।

এ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি কাজী ফারুক বলেন, “ওষুধশিল্পে নৈরাজ্য চলছে। যেমন দুই টাকা দামের হিস্টাসিন ট্যাবলেট এখন বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকায়। তেমনি দুই টাকার রিবোফ্লবিন বিক্রি হচ্ছে পাঁচ টাকায়। দাম বেড়েছে ১৫০ শতাংশ।”

তিনি বলেন, “আমরা অনেক চেষ্টা করেও ওষুধ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারিনি। এমনকি এই প্রশাসনের আওতায় দুটি কমিটির মিটিং নিয়মিত হয় না। এভাবে চলতে থাকলে কিছুদিন পর মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ ওষুধ কিনতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাবে।”

ক্যাব সভাপতি বলেন, “দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো অনেক প্রতিবাদ করে আমরা বিদেশি কোম্পানিগুলোকে তাড়িয়েছিলাম, দেশি কোম্পানিগুলোর বিকাশের স্বার্থে। সাধারণ মানুষ কম দামে ওষুধ পাবে এটা ভেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল আমাদের দেশীয় কোম্পানিগুলো সেই বিদেশিদের জায়গাই দখল করে বসল।”

এদিকে, ওষুধ প্র্রশাসনের মতে, যে কয়টি ওষুধের দাম বেড়েছে সেগুলো কোনভাবেই ১৮০০ জেনেরিক বা ২১ হাজার ব্রান্ডের  ৫ শতাংশের বেশি নয়। ২১ হাজার ব্রান্ড ৫ শতাংশ ওষুধের সংখ্যা হলো ১০৫০টি।

আবার কোনো কোনো ওষুধ কোম্পানি দাবি করে, খুচরা বিক্রেতারা ওষুধের দাম বেশি রাখে।

তবে মোহাম্মদপুর আলম ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা ও ফার্মাসিস্ট মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, “খুচরা বিক্রেতাদের লাভ সীমিত, প্যাকেটের গায়ে যে দাম লেখা থাকে তার চেয়ে বেশি আমরা নিতে পারি না। কোম্পানির কাছে আমরা কমিশন পাই ১৫ শতাংশ। আর পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে থেকে নিলে ১৩ শতাংশ।”

সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে নতুন করে ওষুধনীতি প্রণয়নের অঙ্গীকার থাকলেও, সরকার ক্ষমতা আসার সাড়ে তিন বছরেও তা সম্ভব হয়নি। ফলে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং ভেজাল ওষুধের প্রকোপে জনসাধারণের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, “সরকারের এখনো যেটুকু সময় আছে এর মধ্যেই ওষুধনীতি প্রণয়নের কাজ শেষ করে যাওয়া উচিত হবে। এটা কেবল আমাদের নির্বাচনী অঙ্গিকার নয়, দেশ ও মানুষের স্বার্থেই এটা করতে হবে।”

২০০৫ সালের ওষুধনীতিতে ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ প্রথা বাতিল করায় কিছু দেশীয় কোম্পানির অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে।

দেশীয় ওষুধশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও ওষুধনীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়নি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অসহায় দরিদ্র মানুষের জন্য সুলভ মূল্যে গুণগতমানসম্পন্ন ওষুধপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ।

১৯৯৪ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে ১১৭টি অত্যাবশকীয় ওষুধের (কন্ট্রোলড ড্রাগ) মূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। জনস্বার্থে এসব ওষুধ কোম্পানি উৎপাদন ও বাজারজাত করতে বাধ্য থাকবে বলেও আদেশে বলা হয়। বাস্তবতা হলো ১১৭টি ওষুধের প্রায় অর্ধেকই এখন আর উৎপাদিত হয় না।

সরকারের পক্ষ থেকে অত্যাবশকীয় ওষুধের চাহিদা পূরণ হয়েছে বলা হলেও শহর ও গ্রামাঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর চেহারা বিপরীত সাক্ষ্যই দেয়।

একাধিক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যাকেন্দ্র ও থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে গড়ে ৫০ শতাংশের বেশি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধেরই কোনো সরবরাহ থাকে না।

বাংলাদেশ সময়: ১২০২ ঘণ্টা, আগস্ট ০৭, ২০১২
এটি/এআর/সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর 
জনগণের নয়, দুর্নীতির টাকায় পদ্মা সেতু হোক

মোস্তফা কামাল, অতিথি লেখক
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বিষয়টা গভীর উদ্বেগের। এই উদ্বেগ ও শঙ্কা আমার একার নয়, এ দেশের প্রত্যেক সচেতন মানুষের। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণার পর সারা দেশে যা শুরু হয়েছে, তা রীতিমতো ন্যক্কারজনক। এ পরিস্থিতি এখনই সামাল দিতে না পারলে দেশব্যাপী অরাজকতা-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে খুব একটা সময় লাগবে না। পদ্মা সেতুর চাঁদার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে এরই মধ্যে (১৬ জুলাই) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে এবং তাতে আবদুল্লাহ আল হাসান নামে একজন নিহত হয়েছে। খুবই মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের আরো কত ঘটনা আমাদের দেখতে হয় কে জানে!
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে একজন অতি সাধারণ মানুষও এখন উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চান, `ভাই, দেশটা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে! গণতন্ত্র থাকবে তো! নাকি আবার কোনো অরাজনৈতিক শক্তি জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসবে?` আবার কেউ কেউ বলছেন, `প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এত বিপ্লবী হয়ে উঠলেন! তাঁর শক্তির উৎস কী? নাকি নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মতো অবস্থা তাঁর! তিনি কি টের পেয়ে গেছেন, তিনি আর ক্ষমতায় আসতে পারবেন না! নাকি পেছন থেকে বিশেষ কোনো শক্তি তাঁকে উৎসাহ জোগাচ্ছে! জনগণ পেছনে না থাকলে কোনো শক্তিই যে কাজে আসবে না, তা নিশ্চয়ই শেখ হাসিনা ভালো জানেন।`
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বীরোচিত বক্তব্য দিয়েছেন, তা রাজনৈতিক স্টান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর বক্তব্য বাস্তবসম্মতও নয়। প্রসঙ্গক্রমে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি পারমাণবিক বোমা তৈরি প্রসঙ্গে বলেছিলেন, জনগণের পেটে ছালা বেঁধে হলেও পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে। অর্থাৎ জনগণ না খেয়ে থাকলেও বোমা তৈরি করা হবে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলেও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় পাকিস্তানের নাম রয়েছে। বাংলাদেশের যেন সেই পরিণতি না হয়।
তা ছাড়া সরকারের ভুলের খেসারত জনগণ কেন দেবে? সরকারের একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনা হলো, তখন কেন ব্যবস্থা নেওয়া হলো না? কেন তখন মন্ত্রীর পক্ষেই সাফাই গাওয়া হলো? তা ছাড়া বিশ্বব্যাংক তো দুর্নীতির অভিযোগ অনেক আগেই করেছিল। তখন কেন সরকার চুপ ছিল? এক বছর আগেই তো সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত! গত এক বছরে দেনদরবার তো কম করা হয়নি! বিশ্বব্যাংকের ঋণ পাওয়ার জন্য সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনেক চেষ্টা-তদবির করেছে। তখনই তো সরকার ঘোষণা দিতে পারত, আমরা বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই পদ্মা সেতু করব। এত দিন কেন অপেক্ষা করা হলো? এখন প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বিশ্বব্যাংক কেন দেরি করিয়েছে সে জন্য মামলা করা উচিত।
নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণার পর থেকে ছাত্রলীগের ছেলেরা সারা দেশে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। সর্বত্র এখন এক আলোচনা, `চাঁদা দিন, পদ্মা সেতু গড়ুন।` ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাঙ্গন, অফিস-আদালতে চাঁদাবাজি শুরু হয়ে গেছে। সরকারের লোকেরা একধরনের জুলুম করছে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তারা টাকা দেবে কোত্থেকে? যাদের পেটে ভাত নেই তাদের পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখিয়ে কী লাভ!
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলেও বলা হয়, জানেন না! পদ্মা সেতুর জন্য বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে। এসব কী শুরু হয়েছে দেশে! এর মানে লুটপাটের আরেক পন্থা আর কি! কিন্তু এই দরিদ্র দেশের জনগণ কেন পদ্মা সেতুর অর্থ দেবে?
বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আমলে যে দুর্নীতি-লুটপাট হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে নাকি তিনটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। আমাদের তিনটি দরকার নেই। আপাতত একটি পদ্মা সেতুই করা হোক। সরকার বিনিয়োগের স্বার্থে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। টাকা সাদা করার সুযোগ বন্ধ করে সেই অর্থ পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় করা হোক। এই দাবি এখন সাধারণ মানুষও জানাচ্ছে।
এটা সরকারের জন্য একটা বড় সুযোগও বটে! এর ফলে অনেক দিক থেকেই সরকার লাভবান হতে পারে। এক. বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের কাছে আর ধরনা দিতে হবে না; দুই. দরিদ্র জনগণের মাথায়ও পদ্মা সেতুর বিশাল বোঝা চাপবে না এবং এর ফলে চাঁদাবাজি, লুটপাট বিশৃঙ্খলা বন্ধ হবে এবং তিন. পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ বর্তমান সরকারের মেয়াদকালে শুরু করতে পারলে তা আগামী নির্বাচনে দলের পক্ষে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আওয়ামী লীগের নেতারা বলতে পারবেন, `আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণসহ অনেক উন্নয়নকাজ শুরু করেছি। দেশকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছি।`
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিলের পর এমনিতেই সরকার খুব বেকায়দায় আছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সরকারের ভাবমূর্তি নাজুক। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা দেখলেই তা অনুমান করা সম্ভব। প্রথমে বিশ্বব্যাংক সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরকারকে বড় ধরনের চাপে ফেলে। এই অভিযোগ নিয়ে টানা প্রায় এক বছর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রিপোর্ট হয়েছে। সরকারের ভাবমূর্তির ওপর বিশ্বব্যাংক সর্বশেষ পেরেক ঠুকেছে আকস্মিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে। এর পর পরই মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে সরকারের কর্মকাণ্ডের তুখোড় সমালোচনা করা হয়।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সরাসরি র‌্যাবের কর্মকাণ্ড ও বিডিআর বিদ্রোহের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের সুপারিশ করে। একটি স্বাধীন দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য করার এখতিয়ারই ওই প্রতিষ্ঠানটির নেই। এর পরও কেন বিতর্কিত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হলো, তা রহস্যজনক। তবে এসব কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশকে নিয়ে কত বড় ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু সরকার এ ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা ট্যাকল করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
আঞ্চলিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশের সমস্যা হচ্ছে, এটি একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনার দেশ। এখানে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানগত কারণেও এ দেশটির প্রতি বিশ্বের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র জয়ের পর আমেরিকার কাছে আমাদের গুরুত্ব বহু গুণ বেড়ে গেছে। কারণ তারা বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে একটি স্থায়ী কাঠামো গড়ে তুলতে চায়। চীনকে সামাল দিতে এ ধরনের কাঠামো তাদের খুবই দরকার। সপ্তম নৌবহরের প্রসঙ্গটি এমনিতেই আলোচনায় আসেনি। এর নেপথ্যে অনেক কারণ রয়েছে। ভেতরে ভেতরে চলছে অন্য খেলা।
এশিয়া অঞ্চলে চীনের খবরদারি অথবা বিশাল সমুদ্রজুড়ে চীনের রাজত্ব আর মানতে পারছে না আমেরিকা। ভারতের একার পক্ষে চীনের সঙ্গে বোঝাপড়া করাও সম্ভব নয়। এ কারণেই আমেরিকাকে পাশে রেখে ভারত ফায়দা হাসিল করতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় আমেরিকার উপস্থিতি আপাতত নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না ভারত। হিলারি ক্লিনটনের আকস্মিক ঢাকা সফরের নেপথ্যে এটি একটি বড় কারণ। বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান নৌঘাঁটি স্থাপন করতে পারলে এ অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত হয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনাকে চতুর্মুখী চাপে রেখেছে। পাশাপাশি দেনদরবারও চলছে। বাংলাদেশকে বোঝানো হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহরের উপস্থিতির মাধ্যমে বাংলাদেশের নৌসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মার্কিন প্রস্তাবে রাজি হলে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহ আরো অনেক কিছুই পাবে বাংলাদেশ। আর রাজি না হলে অর্থনৈতিক অবরোধের মতো কঠিন সিদ্ধান্তও নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যে।
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের কয়েক দিন পরই ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশি পোশাক কিনে ঝুঁকি নিতে চান না মার্কিন ব্যবসায়ীরা। তাঁরা তৈরি পোশাক শিল্পে উন্নত পরিবেশ দেখতে চান। দেখতে চান, এখানে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি ও হরতালমুক্ত পরিবেশ। তাঁর বক্তব্যে একধরনের অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের ইঙ্গিত ছিল। তিনি খুব ভালো করেই জানেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বেশির ভাগ তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিলে দেশ মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে।
মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইতে না বইতেই দেশটির ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে চাপে ফেলতে নানা ফন্দি আঁটা হচ্ছে! এসবের মানে কী! চাপে ফেলে বাংলাদেশের কাছ থেকে স্বার্থ আদায় করা! বাংলাদেশ নিশ্চয়ই তার সার্বভৌমত্ব অন্য দেশের হাতে তুলে দেবে না। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে যে জাতি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সে জাতি নিশ্চয়ই কোনো অপশক্তির কাছে মাথা নোয়াবে না।
অনেকেই ধারণা করেছিলেন, হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময়ই মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে গোপনে চুক্তি হয়ে গেছে। এখনো অনেকে এ কথা বিশ্বাস করেন। অনেকে বলেন, হিলারির সময় চুক্তি হয়নি। তাই মার্কিন নৌপ্রধান ঢাকায় এসেছেন। বড় কোনো `ডিল` না হলে সাধারণত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের সফর হয় না। এর মানে `ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!` কালের কণ্ঠ থেকে

  পদ্মা সেতুর নামে চাঁদা নিলেই গ্রেপ্তার  পদ্মা সেতুর নামে দেশের কোথাও চাঁদা আদায়ের ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেশের সব থানাকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজদের চিহ্নিত ও গ্রেপ্তারে পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণের সহায়তাও চাওয়া হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতুর নামে চাঁদা সংগ্রহের কোনো সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি। তবুও বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে শোনা যাচ্ছে। সে কারণে থানাসহ পুলিশের সব ইউনিটকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। জনগণের কাছে এ সংক্রান্ত অভিযোগ থাকলে তা তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ থানায় জানানোর আহ্বান জানাচ্ছি।
পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল এক বিশেষ বেতার বার্তায় দেশের সব থানার কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, কোথাও এ ধরনের চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটলে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ বিষয়ে জনগণের সঙ্গে আলোচনাসহ অনুসন্ধান করার জন্যও কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত অর্থ সংগ্রহের আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকলেও গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা সংগ্রহের তথ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পরদিন থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ব্যানারে চাঁদা সংগ্রহের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে চাঁদা সংগ্রহের উদ্যোগ নিচ্ছে। অথচ সরকার এ বিষয়ে অর্থ সংগ্রহের জন্য দুটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নিলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
পদ্মা সেতুর চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে সর্বশেষ গত রবিবার রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে আবদুল্লাহ আল হাসান সোহেল নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হলে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এ অবস্থায় গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর নামে চাঁদা আদায়ের ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, কাউকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। যারা এ সেতুর নামে চাঁদা তুলছে তারা সবাই চাঁদাবাজ। এর পর পরই পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তারে বিশেষ নির্দেশ জারি করা হয়।
পদ্মা সেতুর জন্য কেউ চাঁদা তুলতে পারবে না : মুহিত
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করার পর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা বলার পর ছাত্রলীগসহ সুবিধাবাদীরা ইতিমধ্যে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এ ধরনের চাঁদাবাজদের ধরে পেটানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
গতকাল সচিবালয়ে সামাজিক বিনিয়োগ ব্যবসা নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ণবিষয়ক এক বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিতি ছিলেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কাউকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সরকার যে দুটি হিসাব খুলবে, সেখানে মানুষ স্বেচ্ছায় টাকা দিতে পারবে। এ সেতুর ব্যাপারে কোথাও কোনো চাঁদা তোলা যাবে না।
পদ্মা সেতুর জন্য কারা চাঁদা তুলবে বা তুলতে পারবে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'চাঁদা তোলার দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি। কেউই চাঁদা তুলতে পারবে না।'
     
দাউ দাউ আগুনে জ্বলছে আরাকান রাজ্যঃ সাগরে ভাসছে লাশ

মুসলিম অধ্যূষিত জনপদ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দাউ দাউ করে আগুনে জ্বলছেআগুনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছে মুসলমানদের শত শত বসতভিটেগতকাল যে লোকটি সহায় সম্পদশালী ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সহায় সম্পদ হারিয়ে অনাহারে-অর্ধহারে মানবেতর জীবন যাপন করছেলুন্ঠিন বাহিন লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে সহায় সম্পদরাখাইনরা মুসলমানদের হত্যা করে লাশ সাগলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছেএসব লাশ বাংলাদেশের জলসীমানায় প্রবেশ করছেএদিকে, মিয়ানমারে নৌ-বাহিনীর আরো দুইটি যুদ্ধ জাহাজ সাগরে অবস্থান করছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানিয়েছেসেনাবাহিনী একতরফা ভূমিকা পালন করছেমংডু বমু পাড়াতে ১২ জুন সকাল ১০টার সময় দুটি মুসলমানের ঘর পুড়িয়ে দিয়ে ভাংচুর লুটপাট চালায়দেশিটির বিশেষ বাহিনী তথা লুন্ঠিন বাহিনী ও রাখাইনেরা যৌথভাবে মিলে আরাকানের মুসলিম অধ্যূষিত জনপদ বন্দর নগরী আকিয়াবের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় গ্রাম নাজির পাড়ার প্রায় ২৭শ’ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছেপুড়িয়ে দিয়েছে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও দোকানপাট মুসলমানদের মৃত লাশ গাড়িতে করে নিয়ে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছেএবং জীবিত ব্যক্তিদেরকে ধরে নিয়ে গাড়িতে করে অজ্ঞত স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছেমিয়ানমার সরকার দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীিয় রাজ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে সেনাবাহিনী নামানোর পাশাপাশি গতকাল আকিয়াব বন্দরের তাদের জলসীমানায় দুটি ফ্রিগেট নিয়মিত টহল দিচ্ছেমুসলমানরা আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে মিয়ানমার নৌ-বাহিনীর হাতে ধরা পড়ছে পরে তাদেরকে সাগরে ডুবিয়ে মারা হচ্ছেগতকাল এসব লাশ সেন্টমার্টিনের অদূরে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী টেকনাফ নয়াপড়ার খুরের মূখের জেলে আবুশুক্কুর ২টি লাশ দেখেছেন বলে জানিয়েছেনগতকাল সকালে ১০টার দিকে আকিয়াবের মৌলভী পাড়া, ও হাড্ডিহলা গ্রামের প্রায় ২৫শ’ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলা হয়েছেআকিয়াবের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে
                                                                  মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিঃ
আরকানে রাখাইনেরা শুধু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ক্ষান্ত হয়নিমুসলামদের নগদ টাকা স্বর্ণঅলংকার লুটপাট করে নিয়ে যাচ্ছে১২ জুন সকাল ৯টার সময় মংডু বাজারের খেলার মাঠ সামনে মোঃ আলরি রামং ফার্মেসী ও বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায় রাখাইনেরা৩নং সেক্টরে কুকুমো ও আকিয়াব থাইমো সহ সেনাবাহিনী কর্মকর্তা সম্মুখে ঘরবাড়ি ও মসজিদে আগুন ও ভাংচুর করে আকিয়াবের জেলার মুসলিম অধ্যূষিত এলাকা মেরে বং অগ্নিসংযোগে নিহতদের মাথা ন্যাড়া করে ভিক্ষুদের লাল পোষাক পড়িয়ে দিয়ে মিয়ানমারের টেলিভিশন চ্যানেলে ও ওয়েবসাইটে অপপ্রচার চালাচ্ছেএদিকে মংডু ওলামা পার্টি নেতা ছিদ্দিক বাড়িতে ও ৪নং সেক্টরের থাকা পুলিশসহ মিলে মোঃ খান ও তৈয়ুবার বসতবাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং গদুছড়ার বাজার থেকে রাখাইনেরা মুসলমানদের মালামাল লুট ও বুসডং থানাধীন টংবাজার মুসলিম অধ্যূষিত এলাকার উচ্চবিত্ত ২শ’ নেতৃস্থানীয় মুসলিমকে সেনাবাহিনী ক্যাম্পে তলব করেএকটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার সে দেশের সেনাবাহিনীকে আরাকান রাজ্যে দাঙ্গা দমনের নামে পাঠানো হলেও মূলত তারা মুসলমানদের দমন এবং রাখাইনদের সহযোগিতার পাশাপাশি তাদের সীমান্ত এলাকাকে জোরদার করেছে মুসলমানেরা ঘর থেকে বের হতে পারছেনাঅনেকের পরিবারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছেমংডুসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে রাখাইনদের ও নাসাকা ও পুলিশের অত্যাচারে সহ্য করতে না পেরে জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে অনেকে যে দিকে পাচ্ছে সেদিকে পালাচ্ছেতারা জেনেছে মুসলমানদের হত্যার পর লাশ গুম করে ফেলা হচ্ছে লুটপাট চালানো হচ্ছে মংডু শহরে মুসলমানদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পুলিশ প্রহরায় রাখাইনরা হামলা চালাচ্ছে মুসলমানদের উপরএদিকে আরাকানে বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ প্রতিবাদে মালয়শিয়াতে মিয়ানমার প্রবাসীযুবকেরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেমালয়শিয়া থেকে মোবাইল ফোনে এ তথ্য জানিয়েছেন প্রসঙ্গত ভৌগলিক দিক থেকে মিয়ানমারে পশ্চিমে বাংলাদেশ, পূর্বে চীন, দক্ষিণে থাইল্যান্ড, উত্তরে ভারত, সংগত কারণে আরাকানের মুসলমানেরা নির্য়াতিত হলে বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যূষিত রাষ্ট্র এবং মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় বরাবরই রোহিঙ্গা সম্প্রদায় গোষ্ঠী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশের চেষ্টাএসব রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে ও নারাজএকাধিক সূত্র জানিয়েছে গত ৫ দিনের সহিংসহার জের ধরে প্রায় ৫ শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু ট্রলারে বাংলাদেশের জলসীমার শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিনের কাছাকাছি সাগরে ভাসছেএকদিকে কোষ্টগার্ড বিজিবি তৎপরতার কারণে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ বাধাগ্রস্থ হচ্ছেঅপরদিকে মিয়ানমারের নৌ-বাহিনী ও নাসাকা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সেদিকেও ঢুকতে পারছে নানিরুপায় হয়ে তারা সাগরে ভাসছে!
বাংলাদেশের সীমান্ত পরিস্থিতিঃ
এ প্রসঙ্গে টেকনাফস্থ ৪২ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর শফিকুর রহমান জি জানিয়েছেন, পুরো সীমান্ত এলাকায় রের্ড এলাট জারি করা হয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে টেকনাফ উপজেলার শামলাপুরে একটি অস্থায়ী বিজিবির চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে সীমান্তে বিজিবি সদস্য বাড়ানো ও অবৈধ অনুপ্রবেশ আশংকা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার ও বিওপিগুলোকে সতর্কবস্থায় রাখা হয়েছেনাফ নদীতে টহল জোরদার করা হয়েছেযে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসমূহ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রাখা হয়েছেবর্তমানে বন্দর ও ট্রানজিট ঘাট সমূহের কার্যক্রম অঘোষিতভাবে বন্ধ হয়ে গেছে


এ্যাপোলো কি আইনের উর্ধ্বে?
মরদেহ জিম্মি করে অর্থ আদায়

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: রাজধানী ঢাকার এ্যাপোলো হাসপাতালে দুর্নীতি, ভুল চিকিৎসা, প্রতারণা, দালালদের দৌরাত্ম্য সবই আছে। কেবল একটি মাত্র জিনিসই নেই বিশ্বব্যাপী ‘সমাদৃত’ এ হাসপাতালটিতে; ‍আর তা হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়ী মনোভাব প্রতিষ্ঠানটিকে সেবা-বিরোধী করে তুলেছে। এমনকি রোগী বা মরদেহ জিম্মি করে অর্থ আদায়ের নজিরও পাওয়া গেছে।

জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ার পর চার বছর আগে নীলফামারির সৈয়দপুর উপজেলার বাঁশবাড়ী এলাকার আবদুল মজিদ মণ্ডলের মেয়ে রিপা সরকারকে ভর্তি করা হয়েছিল এ্যাপোলোতে। অস্ত্রোপচার করে টিউমার অপসারণের পর রিপাকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কিছুদিন পর আবার পেটে ব্যথা শুরু হয় রিপার। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় কোনো রোগ ধরা পড়ছিল না। সর্বশেষ ২৮ জুন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রংপুরের আইডিয়াল জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে যেটা অপসারণ করা হয়েছে, সেটা এ্যাপোলো হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের সময় পেটের ভেতর রেখে দেওয়া কাপড় (মপ)।

কয়েক মাস আগের ঘটনা। ঠাণ্ডা, সর্দি, জ্বর ও মাথাব্যথা নিয়ে হিউবার্ট রয় নিন্টু (৪৫) ভর্তি হন অ্যাপোলো হাসপাতালে। ভর্তির পর চিকিৎসকরা তাকে ইনজেকশন দেন। এতে তার অবস্থার অবনতি ঘটে। শরীর ফুলে যায়। এরই মধ্যে দুই দফা স্ট্রোক করেন তিনি। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে রাখার ১২ দিন পর মৃত্যু ঘটে তার। কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও ৭০ হাজার টাকা মূল্যের আরেকটি ইনজেকশন পুশ করা হয় নিন্টুর শরীরে।

রোগীর স্বজনদের কাছে চিকিৎসা-ব্যয় হিসেবে বিল ধরিয়ে দেওয়া হয় সাড়ে ৫ লাখ টাকার। পুরো টাকা না দেওয়া হলে লাশ দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। স্বজনদের অভিযোগ, নিন্টুর মৃত্যু হয়েছে ভুল চিকিৎসায়। তারা হাসপাতাল চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। বাড্ডা থানায় একটি জিডিও করা হয়।

এ্যাপোলো হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু আর অস্ত্রোপচারের পর পেটের ভেতর কাপড় রেখে সেলাই করে দেওয়ার ঘটনা নতুন নয়।

এমন ঘটনা এখানে প্রায়ই ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। লাইফ সাপোর্টের নামে চলছে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়। ভুল চিকিৎসায় কেউ মারা গেলে বা অতিরিক্ত বিল আদায় করে নিলেও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছেন না রোগীর স্বজনরা। পুরো বিল পরিশোধ করে তবেই লাশ বা রোগীকে হাসপাতাল থেকে ফেরত নিতে হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ্যাপোলো হাসপাতালে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা। সরকারি কোনো তদারকি না থাকায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তাদের প্রশ্ন, চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা এ হাসপাতালে হচ্ছেটা কি?

এ্যাপোলোর বিরুদ্ধে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা অহরহ। গত বছর আগস্টের মাঝামাঝি একজন উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তার এক মেয়েকে অসুস্থ অবস্থায় ভর্তি করা হয় এখানে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ওই রোগীর শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু শনাক্ত করা হয়। এর ভিত্তিতে চিকিৎসা চলার একপর্যায়ে রোগীর মৃত্যু ঘটে।

এ্যাপোলোর নিজস্ব আয়-ব্যয়ের হিসাব খতিয়ে দেখা যায়, যেখানে ২০০৯ সালে নিট লাভ ছিল সাত কোটি ১২ লাখ ২৪ হাজার ১১২ টাকা, সেখানে এক বছরের মাথায় নিট লাভের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ কোটি ৭৭ লাখ ১৬ হাজার ৫৭৬ টাকা। পরের বছর ২০১১ সালে তাদের নিট লাভের পরিমাণ ছিল ১০০ কোটি টাকার বেশি।

অন্যান্য নামি হাসপাতালের চেয়ে এ্যাপোলোতে চার্জ নেওয়া হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি। সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, নানা প্রক্রিয়ায় ইচ্ছামাফিক বিল আদায় করছে তারা।

এ্যাপোলো হাসপাতাল সূত্র জানায়, জরুরি বিভাগে প্রথম ঘণ্টার জন্য সার্ভিস চার্জ এক হাজার টাকা। পরের প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। আর ডাক্তার ফি রাত ১১টা পর্যন্ত ৭০০ টাকা এবং রাত ১১টার পর এক হাজার ৪০০ টাকা। ওষুধ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিল আলাদা। এছাড়া একেক ধরনের ওটির জন্য একেক হারে চার্জ রয়েছে। এ হাসপাতালে মোট ২৩টি ক্যাটাগরির বেড রয়েছে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন স্ট্যান্ডার্ড ক্যাটাগরির বেডের ভাড়া দৈনিক দুই হাজার ৫০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ স্যুটের ভাড়া ১৬ হাজার টাকা। তবে বেশির ভাগ বেডের ভাড়া দৈনিক আট হাজার টাকা। এ হাসপাতালে বেড চালু আছে ৩৫৮টি। এ ছাড়া নতুন নতুন প্যাকেজ আকারে চেকআপের নামে রোগীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি হারে টাকা। বিশেষ করে হোল বডি চেকআপ ফি বাবদ নেওয়া হচ্ছে পুরুষদের জন্য ১৫ হাজার আর নারীদের জন্য ১৭ হাজার টাকা। একইভাবে হার্ট চেকআপ প্যাকেজের নামে নেওয়া হচ্ছে ১১ হাজার টাকা, লিভার স্ক্রিনিংয়ের জন্য ৯ হাজার ৫০০ টাকা, ডায়াবেটিক প্যাকেজ চেকআপের জন্য আট হাজার টাকা।

এ্যাপোলোর লাইফ সাপোর্ট নিয়ে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনে ভেনটিলেটর ব্যবহার কিংবা রোগী মারা যাওয়ার পরও ভেনটিলেটর ব্যবহারের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার হচ্ছে। বেসরকারি ফার্মের একজন চাকুরে হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসা নিয়ে বাঁচার আশায় শেষ সম্বল বিক্রি করে ভর্তি হন ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে। খরচের তালিকা অনুযায়ী দৈনিক নির্দিষ্ট একটি অঙ্কের টাকা বিল আসার কথা ভাবেন তিনি। আংশিক সুস্থ হয়ে ওঠেন। প্রয়োজন না হলেও তাকে দেওয়া হয়লাইফ সাপোর্ট। রাখা হয় আইসিইউতে। কেন আইসিইউতে রাখা হলো, চিকিৎসকের কাছে পেলেন না এর সদুত্তর। এক মাস পর তাকে ধরিয়ে দেওয়া হয় ১৩ লাখ টাকার বিল।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, এ্যাপোলোর অধিক ব্যবসায়িক প্রবণতার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের নজরে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় এ্যাপোলোসহ বড় হাসপাতালগুলো নিয়ে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। অধিদপ্তরের ওপর এসব বিষয় মনিটরিং করার দায়িত্ব রয়েছে।

বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে এ্যাপোলো হাসপাতালে রোগী ভাগিয়ে আনার ঘটনাও ঘটছে। আর এ কাজটি করছেন চিকিৎসকরাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ্যাপোলোর একজন চিকিৎসক বলেন, প্রতি মাসে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকরা দুই শতাধিক রোগী পাঠান এ হাসপাতালে। এর বিনিময়ে তারা বিশেষ কমিশন পেয়ে থাকেন। অনেক সময় চেকের মাধ্যমে কমিশনের অর্থ পরিশোধ করা হয়। মার্চে ২৪৮ জন রোগী আসে বিভিন্ন চিকিৎসকের মাধ্যমে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম, ল্যাবএইড, সোহরাওয়ার্দী, হৃদরোগ হাসপাতাল থেকেও সেখানে কর্মরত চিকিৎসকরা রোগী পাঠিয়েছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৯ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১২
 
 
অবশেষে পরিস্কার হলো কেনো ”পিলখানা বিদ্রোহ” ঘটিয়ে বিডিআর ধংস করেছিলো ভারত!!
এ মুহুর্তে বাংলাদেশে ভূমিতে ভারতীয় বিএসএফের অন্তত ১০ টি ক্যাম্প রয়েছে। এ সব ক্যাম্প করা হয়েছে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের সীমান্তবর্তী এলাকা পাদুয়ায়। এসব সাব ক্যাম্পে ১০ জনের মতো বিএসএফ সদস্য ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছে। তারা ইতোমধ্যে ২০০১ সালে বাংলাদেশের উদ্ধার করা ২৩০ একর ভূমি ফের দখল নিয়েছে। আরো ১৩০ একর ভূমি বাংলাদেশের দখলে থাকলেও সেখানে বাংলাদেশীদের চাষাবাদে এ বছর থেকে বাধা দেয়া হচ্ছে।
২০০১ সালের এপ্রিল মাসে এই পাদুয়ার যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করে ২৩০ একর ভূমি পূর্নদখল করেছিলো বাংলাদেশের বিডিআর বাহিনী। বিডিআর প্রধান জেনারেল আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে ঐ যুদ্ধে ভারতের ১৫ জন বিএসএফ নিহত হয়েছিলো। তখন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জসবন্ত সিং ভারতীয় লোকসভায় বলেছিলেন, “বাংলাদেশকে এর পরিনাম ভোগ করতে হবে।” ৯ বছর পরে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী বিডিআর বিদ্রোহ ঘটিয়ে ভারতীয় কমান্ডোরা ঢুকে ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যা করে বিডিআর অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটায়।
এর পরে নাম পাল্টে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড কে বিজিবি বানানো হয়। এই বিজিবির আর বিডিআরের সেই শৌর্যবীর্জ নাই। বাংলাদেশের পাদুয়ায় ভারত যে বিএসএফ বানিয়েছে বিজিবি এটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। তারা দিনের বেলায় বাংলাদেশীদের তাদের ভূমিতে যেতে বাধা দিচ্ছে। এতে ওই জমির ওপর নির্ভরশীল শতাধিক বাংলাদেশী পরিবার মানবেতর জীবন যাপন করছে। তবে স্থানীয় বিজিবির প্রতাপপুর ক্যাম্পের ইনচার্জ ফোরকান নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘সীমান্তের পরিস্থিতি খুবই ভালো। এসব নিয়ে রিপোর্ট করার কিছু নেই।’ সরেজমিন পাদুয়ায় ঘুরে দেখা গেছে, ১২৭০ নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে ১২৭১ ফোর এস পিলার পর্যন্ত বিএসএফ ১০টি ক্যাম্প বসিয়েছে। তা ছাড়া তাদের একটি মূল ক্যাম্পও রয়েছে এর মধ্যে। তারা দিনে ও রাতে কঠোর তদারকি করছে। কোনো লোক দেখামাত্র হুইসেল দিচ্ছে। বাংলাদেশীদের তাদের জমিতে যেতে দিচ্ছে না। পিয়াইন নদীর পারে পানতুমাই গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, ‘আমরা আমাদের জমিতে চাষ করতে গেলে বিএসএফ বাধা দেয়। একইভাবে আমাদের বিজিবিও সেখানে যেতে নিষেধ করে।’ আমাদের জমিতে আমরা কেন যেতে পারব না?
আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কথা কেউ শোনে না। বিজিবি আমাদের চুপ থাকতে বলে, তাই আমরা চুপ থাকতে বাধ্য হই। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?’
বাংলার মানুষ, এখনই সজাগ হও

No comments:

Post a Comment